ঢাকা-রাজশাহী রুটে গত সোমবার মধ্যরাতে ইউনিক রোড রয়েলস পরিবহরের একটি বাস ডাকাতের কবলে পড়ে। বাসটিতে ডাকাতির পাশাপাশি ধর্ষণ করা হয় বলেও অভিযোগ করেছেন যাত্রীরা। তাদের অভিযোগের ভিত্তিতে নাটোর পুলিশ ওই বাসের চালক, চালকের সহকারী ও সুপারভাইজারকে আটক করে আদালতে সোপর্দ করলেও অভিযুক্তরিা জামিনে মুক্তি পেয়েছেন বলে জানা গেছে।
ওই বাসে থাকা কয়েক জন যাত্রীর সঙ্গে কথা বলে ঘটনার বিস্তারিত জানার চেষ্টা করেছে বিবিসি বাংলা। ওই বাসের যাত্রী ছিলেন ব্যবসায়ী সোহাগ হাসান (২২)। তার বাড়ি নাটোরের বড়াইগ্রামে। ব্যবসার কাজে এই গ্রামেরই ওমর আলী এবং তিনি একসঙ্গে ঢাকায় গিয়েছিলেন। সেদিন কাজ শেষ করতে দেরি হয়ে গেলে তাড়াহুড়ো করে তারা ওই বাসেই উঠে পড়েন।
তিনি বলেন, ‘গাড়ি যাত্রী বোঝাই থাকলেও গাড়ির চালক ও তার সহযোগীরা আরও সাত-আটজনকে মাঝপথে গাড়িতে তুলে এবং তারপর গাড়ির চালকের আসনে তাদেরই একজন বসে পড়ে। ওই দলের বাকিরা তখন যাত্রীদের কাছে চলে আসে এবং গলায় চাকু ধরে। তারা বাসের আলো জ্বালাতে নিষেধ করেছিল।’
সোহাগ হাসান বলেন, ‘আর সবচেয়ে বড় কথা, সবার সামনে ওরা চাকু নিয়ে দাঁড়ায়ে ছিল। পাঁচ-ছয়জনকে ছুরিও মারে ওরা। এই ভয়ে কেউ কোনো কথা বলেনি। সবার মাথা নিচু করে ছিল। ওরা বলছিল, চোখ বন্ধ কইরা থাকবি। তাকাইলে কানা করে দিব।’
তিনি দাবি করেন, তার ও ওমর আলীর কাছে ১ লক্ষ ২০ হাজার টাকা ছিল। ডাকাতরা চাইলে তারা শুরুতে ২০ হাজার টাকা দেন, কিন্তু গাড়ির চালক-সহযোগীরা ডাকাতদেরকে দেখিয়ে দেয় যে তাদের কাছে আরও টাকা আছে।
সোহাগ বলেন, ‘আমি টাকা দিতে চাইনি বলে ওরা আমায় নিচে ফেলে আমার বুকের ওপর পাড়া দিয়ে রাখছে, টাকা না দেওয়া পর্যন্ত। আর ওরা বাস থেকে না নামা পর্যন্ত আমায় নিচেই রাখছে।’
এ সময় তিনি ও ওমর কথা বলতে পারছিলেন না, মাথা উঁচু করতে পারছিলেন না, চোখ খুলতে পারছিলেন না। শুধুই বাসের দুই নারী যাত্রীর চিৎকার আর কান্নার আওয়াজ শুনছিলেন।
হাসান বলেন, ‘ওই দুইজনের (নারী) সিট ছিল বাসের মাঝামাঝি। তাদের মাঝে একজন হিন্দু, তার সাথে তার স্বামীও ছিলেন। ডাকাতরা প্রথমে ওই নারীর কাছে যা যা ছিল, সব নিয়ে নেয়। এরপর চিকন করে একজন ছেলে আমাদের সামনেই ওই মহিলাকে টানতে টানতে জোর করে পেছনের সিটে নিয়ে চলে যায়। ওর স্বামী বাধা দিতে গেলে স্বামীকে অনেক মারধর করে।’
তিনি, ‘এরা (ডাকাতরা) যে পরিমাণ... উনি (ভুক্তভোগী নারী) ধর্ষণেরও শিকার হয়েছে। পিছে নিয়ে গেলে উনি অনেক চিৎকার করছিল। ওদিকে আমাদের যেতে দিচ্ছিলো না। আমরা শুধু চিৎকারের আওয়াজ পাচ্ছিলাম। জোরে জোরে কাঁদতেছিল, কিন্তু ওখানে আমাদের কিছুই করার ছিল না। ধর্ষণ না করলে কেউ এ রকম চিৎকার করবে না।’
গুড় ব্যবসায়ী মজনু আকন্দও (৭৩) সেদিন ওই বাসে ছিলেন। তিনি বলেন, ‘ওই রাতে আমরা যে চিল্লাচিল্লি শুনছি... তাতে মা-বোনের ইজ্জতের...গাড়ির ভেতরে আমাদের কোনো ভাষা ছিল না। ওনাদের মানসম্মানের ক্ষতি করছে, ধস্তাধস্তি করছে।’
মজনু বলেন, সবচেয়ে বেশি নির্যাতনের স্বীকার হয়েছেন দুইজন নারী। একজনের বয়স ছিল আনুমানিক ২০ বছর, আরেকজনের ২৫-৩০ বছর।
তিনি বলেন, ‘ওই দুই নারী থানায় ধর্ষণের অভিযোগ করছে কি না জানি না। গাড়ির মাঝে দুইজন যে নির্যাতিত হইছে, সেটা আমরা জানি।’
দ্বিতীয় যে নারীর কথা বলা হচ্ছে, তার বিষয়ে সোহাগ হাসান বলেন, ‘আরেকজন মহিলা, ২৫-৩০ বছর বয়স হবে। ওনার সবকিছুই নিয়ে নিছে। উনি আমাদের দুই সিট সামনে ছিল। আমাদের তাকাইতে দিচ্ছিল না। ওনার গায়ের বিভিন্ন জায়গায় হাত দিচ্ছিল। আমরা যখন বারবার প্রতিবাদ করতে যাচ্ছি, তখন আমাদের মারতে চেষ্টা করে...পেছনে শুধু হিন্দু মেয়েটাকেই নিয়ে যায়। আর ওনার সাথে সিটের ওখানে বসেই জোরজবরদস্তি করে।’
বড়াইগ্রাম থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘২টার দিকে (রাত) গাজীপুর বা টাঙ্গাইল থেকে গাড়িতে ডাকাত গাড়িতে উঠে। যাত্রীদের কাছ থেকে তারা সব নিয়ে নেয়। পরে ভোর ৫টার দিকে কোথাও নেমে যায়, টাঙ্গাইল বা গাজীপুরে।’
ডাকাতরা বাস থেকে নেমে গেলে মঙ্গলবার ভোর ৬টার দিকে যাত্রীরা মির্জাপুর থানায় গিয়ে মৌখিক অভিযোগ করে আড়াইটার দিকে বড়াইগ্রামে আসেন বলেও তিনি জানান।
ওসি বলেন, ‘যাত্রীরা বাস আটক করে বলে যে ড্রাইভার-হেল্পাররা জড়িত এই ঘটনায়। তাদের যাত্রীদেরকে ওদের ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। পরে আমরা গিয়ে ওদের আটক করি।’
এই ঘটনায় মামলা নেওয়া হয়নি উল্লেখ করে এই পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, তারা যাত্রীদেরকে মির্জাপুর বা টাঙ্গাইল বা গাজীপুরে মামলা করার পরামর্শ দিয়েছেন। কারণ ঘটনা সেখানে ঘটেছে।
এদিকে টাঙ্গাইলের মির্জাপুর থানার ওসি মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘গাজীপুরের চন্দ্রা এলাকায় বাসটি এলে সাত-আটজনের ডাকাত দল গাড়িতে উঠে গাড়ির নিয়ন্ত্রণ নেয়। মির্জাপুর সীমানায় এটা ঘটেনি। আর এ ব্যাপারে মির্জাপুর থানায় কেউ অভিযোগ করেনি।’
ডাকাতরা ডাকাতি শেষে নন্দন পার্কের পাশে এসে নেমে যায় বলেও তিনি জানান।
উভয় থানার ওসি জানিয়েছেন, তাদের কাছে কোনো নারীই ধর্ষণের অভিযোগ করেননি।
0 মন্তব্যসমূহ