২০০৮ সালের ২৬ নভেম্বর, মুম্বাই শহরে ঘটে যাওয়া সন্ত্রাসী হামলা ভারতীয় ইতিহাসের অন্যতম ভয়াবহ ঘটনা। এই হামলার উদ্দেশ্য ছিল ভারতকে অস্থিতিশীল করা এবং জাতীয় নিরাপত্তার জন্য এক গুরুতর চ্যালেঞ্জ তৈরি করা। হামলাটি সন্ত্রাসী গোষ্ঠী লস্কর-এ-তৈবার দ্বারা পরিচালিত হয় এবং এটি শুধু মুম্বাইয়ের নিরাপত্তাকেই প্রভাবিত করেনি বরং সারা দেশের সন্ত্রাসবিরোধী নীতিতে পরিবর্তন এনেছে।
হামলার পরিকল্পনা এবং প্রস্তুতি:
হামলার পরিকল্পনা করা হয়েছিল পাকিস্তানের লস্কর-এ-তৈবা গোষ্ঠীর দ্বারা। হামলাকারীদের শ্রীলঙ্কার একটি প্রশিক্ষণ শিবিরে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল এবং তারা জলপথে মুম্বাইতে প্রবেশ করে। হামলাকারীরা ১০ জন সদস্য নিয়ে গঠিত একটি গ্রুপ হিসেবে বিভিন্ন স্থানে হামলা চালায়।
হামলার সময়সূচি:
হামলা শুরু হয় রাত ৮ টার দিকে, যখন হামলাকারীরা প্রথমে লিওপোল্ড ক্যাফে এবং পরবর্তীতে ছত্রপতি শিবাজি টার্মিনাসে গুলি চালায়। সেখান থেকে তারা তাজ হোটেল এবং ওবেরয় হোটেলে প্রবেশ করে, যেখানে তারা অতিথিদের জিম্মি করে এবং নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে।
তাজ হোটেলের হামলা:
তাজ হোটেল হামলার সময় অতিথিদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। হামলাকারীরা সেখানে গুলি চালায়, গ্রেনেড নিক্ষেপ করে এবং অতিথিদের জিম্মি করে। হোটেলটিতে ২০০-রও বেশি অতিথি এবং কর্মচারী উপস্থিত ছিলেন। হামলাকারীদের লক্ষ্য ছিল বিদেশি অতিথিদের ওপর আক্রমণ করা, যা তাদের উদ্দেশ্যকে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড হিসেবে সুস্পষ্ট করে তোলে।
ক্ষয়ক্ষতি:
হামলায় মোট ১৬৪ জন নিহত হন, যাদের মধ্যে ভারতীয় নাগরিক, বিদেশী পর্যটক এবং নিরাপত্তা কর্মী ছিলেন। তাজ হোটেলে অন্তত ৩১ জন নিহত হন এবং আহত হন ৩০০-এরও বেশি মানুষ। হামলার পর অবশিষ্ট অতিথিরা নিরাপত্তা বাহিনীর সহযোগিতায় হোটেল থেকে বের হতে সক্ষম হন।
নিরাপত্তা বাহিনীর প্রতিক্রিয়া:
হামলার পরে, মুম্বাই পুলিশ এবং ন্যাশনাল সিকিউরিটি গার্ড (NSG) অবিলম্বে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার জন্য হোটেলে পৌঁছায়। নিরাপত্তা বাহিনী হামলাকারীদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করে, যা প্রায় ৬০ ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে চলে।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা:
হামলার পেছনে হাফিজ সঈদের নাম উঠে আসে, যিনি লস্কর-এ-তৈবার প্রতিষ্ঠাতা। হামলার পরে ভারতের সরকার পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক মঞ্চে অভিযোগ তোলে এবং এই ঘটনার জন্য পাকিস্তানকে দায়ী করে।
পরবর্তী প্রতিক্রিয়া ও পরিবর্তন:
এই হামলার পর ভারত সরকারের নিরাপত্তা ব্যবস্থায় ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে। বিভিন্ন নিরাপত্তা সংস্থার মধ্যে সমন্বয় বাড়ানো হয়, এবং সন্ত্রাসবিরোধী কার্যক্রমে নতুন প্রযুক্তি এবং পদ্ধতি প্রয়োগ শুরু হয়।
নিরাপত্তা ব্যবস্থা ও নতুন নীতি:
হামলার পর মুম্বাই এবং অন্যান্য শহরে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়। সারা দেশে সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপন, স্থানীয় পুলিশ বিভাগের আধুনিকীকরণ এবং জরুরি পরিষেবার উন্নয়নে মনোযোগ দেওয়া হয়।
বিশ্বব্যাপী প্রতিক্রিয়া:
এই হামলার পরে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও প্রতিক্রিয়া জানায়। বিভিন্ন দেশ ভারতের নিরাপত্তার প্রতি সমর্থন জানিয়ে তাদের সহযোগিতা বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি দেয়।
উপসংহার:
মুম্বাই হামলা ২০০৮ একটি ভয়াবহ এবং ট্রাজেডিক ঘটনাবলী যা ভারতীয় সমাজের ওপর গভীর প্রভাব ফেলেছে। এটি সন্ত্রাসবিরোধী নীতিতে পরিবর্তন, নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার এবং জাতীয় নিরাপত্তা বিষয়ক সমালোচনা নিয়ে এসেছে। হামলার ফলে যে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তা শুধুমাত্র মানবীয় ক্ষতি নয়, বরং এটি ভারতের নিরাপত্তা এবং সামগ্রিক সামাজিক পরিস্থিতির উপর একটি অন্ধকার ছায়া ফেলেছে।
0 মন্তব্যসমূহ