২য় বিশ্বযুদ্ধ: কারণ, শুরু হওয়ার প্রক্রিয়া এবং ফলাফল


২য় বিশ্বযুদ্ধ (১৯৩৯-১৯৪৫) ইতিহাসের সবচেয়ে বিধ্বংসী এবং ব্যাপক যুদ্ধ, যা ছয় বছরেরও বেশি সময় ধরে বিশ্বজুড়ে সংঘটিত হয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ভার্সাই চুক্তি, বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দা, ফ্যাসিবাদী শক্তির উত্থান, এবং জাতিসংঘের পূর্বসূরি লীগ অব নেশনসের ব্যর্থতা এই যুদ্ধের প্রধান কারণ ছিল। ২য় বিশ্বযুদ্ধ শুধু সামরিক সংঘর্ষের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না; এটি মানব সভ্যতার উপর গভীর প্রভাব ফেলে এবং আধুনিক বিশ্বের ভিত্তি স্থাপন করে।


যুদ্ধ শুরুর কারণ

১. প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রভাব

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষে স্বাক্ষরিত ভার্সাই চুক্তি ছিল জার্মানির জন্য অত্যন্ত অপমানজনক। এই চুক্তিতে জার্মানিকে বিশাল ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য করা হয় এবং তাদের সামরিক শক্তি সীমিত করা হয়। ফলে জার্মান জনগণের মধ্যে ক্ষোভ ও অসন্তোষ সৃষ্টি হয়, যা হিটলারের মতো নেতা এবং ফ্যাসিবাদী আদর্শের উত্থানে সহায়ক হয়।

২. ফ্যাসিবাদের উত্থান

জার্মানিতে আডলফ হিটলার এবং তার নাৎসি পার্টি, ইতালিতে বেনিতো মুসোলিনি, এবং জাপানে সামরিকবাদী শাসকরা ফ্যাসিবাদী মতাদর্শ প্রচার করতে থাকে। তাদের মূল লক্ষ্য ছিল সামরিক শক্তি বৃদ্ধি, নতুন উপনিবেশ দখল, এবং জাতীয়তাবাদী এজেন্ডা বাস্তবায়ন।

৩. লীগ অব নেশনসের ব্যর্থতা

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্ব শান্তি রক্ষার জন্য গঠিত লীগ অব নেশনস কোনো কার্যকর ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হয়। জাপানের মাঞ্চুরিয়া দখল (১৯৩১), ইতালির ইথিওপিয়া আক্রমণ (১৯৩৫), এবং স্পেনের গৃহযুদ্ধে লীগ কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারেনি।

৪. জোট গঠন এবং প্রতিযোগিতা

  • অ্যাক্সিস শক্তি: জার্মানি, ইতালি, এবং জাপান একত্রিত হয়ে অ্যাক্সিস জোট গঠন করে।
  • মিত্রশক্তি: ব্রিটেন, ফ্রান্স, এবং পরবর্তীতে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্র মিত্রশক্তির অংশ হয়।

৫. অর্থনৈতিক সংকট

গ্রেট ডিপ্রেশন বা বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দার ফলে ইউরোপের দেশগুলোতে রাজনৈতিক অস্থিরতা বেড়ে যায়। এই সংকটকে হিটলার ও মুসোলিনি তাদের সামরিক সম্প্রসারণের ন্যায্যতা হিসেবে ব্যবহার করে।


যুদ্ধ শুরুর প্রক্রিয়া

১. জার্মানির আগ্রাসন

  • পোল্যান্ড আক্রমণ (১ সেপ্টেম্বর, ১৯৩৯): হিটলার জার্মানির জন্য 'লেবেনসরাম' (জীবনধারণের জন্য স্থান) দাবি করে পোল্যান্ড আক্রমণ করে।
  • ব্রিটেন ও ফ্রান্সের যুদ্ধ ঘোষণা (৩ সেপ্টেম্বর, ১৯৩৯): পোল্যান্ডের বিরুদ্ধে আক্রমণের প্রতিক্রিয়া হিসেবে ব্রিটেন ও ফ্রান্স জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে।

২. জাপানের আক্রমণ

  • জাপান ১৯৩৭ সালে চীনে আক্রমণ চালায় এবং এশিয়ায় সামরিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে চায়।
  • ১৯৪১ সালে পিয়ার্ল হারবার আক্রমণ: জাপান যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনী ঘাঁটি পিয়ার্ল হারবারে হামলা চালালে যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে।

৩. সোভিয়েত ইউনিয়নের ভূমিকা

  • ১৯৪১ সালে জার্মানি সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে অপারেশন বারবারোসা চালু করে, যা যুদ্ধের দিক পরিবর্তন করে।

৪. বিশ্বযুদ্ধের বিস্তার

২য় বিশ্বযুদ্ধ ইউরোপ, এশিয়া, আফ্রিকা এবং প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে।


যুদ্ধের ফলাফল

১. মানবিক ক্ষয়ক্ষতি

  • প্রায় ৭ কোটি মানুষ নিহত হয়, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য অংশ বেসামরিক মানুষ।
  • হিটলারের নেতৃত্বে হলোকাস্ট চলাকালে প্রায় ৬০ লাখ ইহুদিসহ অসংখ্য সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী নির্মূল হয়।

২. রাজনৈতিক পরিবর্তন

  • জার্মানির বিভক্তি: যুদ্ধ শেষে জার্মানি পূর্ব ও পশ্চিম জার্মানিতে বিভক্ত হয়।
  • সোভিয়েত শক্তির উত্থান: সোভিয়েত ইউনিয়ন যুদ্ধ শেষে একটি মহাশক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়।
  • নতুন শক্তির বিন্যাস: যুক্তরাষ্ট্র এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন হয়ে ওঠে বিশ্বের দুই প্রধান শক্তি, যা পরবর্তীতে ঠান্ডা যুদ্ধের ভিত্তি তৈরি করে।

৩. জাতিসংঘের প্রতিষ্ঠা

ভবিষ্যতে যুদ্ধ প্রতিরোধের জন্য জাতিসংঘ (United Nations) গঠন করা হয়। এটি আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ ছিল।

৪. অর্থনৈতিক প্রভাব

  • ইউরোপের দেশগুলোর অর্থনীতি ধ্বংস হয়ে যায়।
  • যুক্তরাষ্ট্রের মার্শাল প্ল্যান অর্থনৈতিক পুনর্গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

৫. উপনিবেশবাদের পতন

যুদ্ধের পর বিশ্বব্যাপী উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন তীব্র হয়, যা এশিয়া ও আফ্রিকার দেশগুলোর স্বাধীনতাকে ত্বরান্বিত করে।


উপসংহার

২য় বিশ্বযুদ্ধের প্রভাব এতটাই গভীর যে এটি আধুনিক বিশ্বের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামাজিক কাঠামোকে পরিবর্তন করে। যুদ্ধের কারণে পৃথিবী অভূতপূর্ব ধ্বংসযজ্ঞের শিকার হলেও এটি অনেক গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা রেখে যায়। বিশেষত, জাতিসংঘের গঠন এবং মানবাধিকারের গুরুত্ব প্রতিষ্ঠা এই যুদ্ধের প্রধান অর্জন। তবে, এই যুদ্ধ আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, জাতীয়তাবাদ, সামরিক আগ্রাসন, এবং আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক ব্যর্থতা কতটা বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ