ভারতের অন্যতম ধনী ও প্রভাবশালী পরিবার হলো আম্বানি পরিবার। মুকেশ ও আনিল আম্বানি দুজনই ভারতীয় শিল্পপতি এবং রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজের প্রতিষ্ঠাতা ধীরুভাই আম্বানির সন্তান। কিন্তু তাদের মধ্যে বেশ কয়েকটি পারিবারিক ও ব্যবসায়িক দন্দ রয়েছে, যা মিডিয়া এবং সাধারণ মানুষের আলোচনায় দীর্ঘদিন ধরে রয়েছে। এই প্রবন্ধে মুকেশ ও আনিল আম্বানি সম্পর্কে কিছু অজানা তথ্য ও তাদের দন্দের পটভূমি নিয়ে আলোচনা করব।
মুকেশ ও আনিল আম্বানি: প্রারম্ভিক জীবন ও শিক্ষা
মুকেশ আম্বানি ও আনিল আম্বানি ধীরুভাই আম্বানি ও কোকিলাবেন আম্বানির সন্তান। মুকেশ আম্বানি ১৯৫৭ সালে জন্মগ্রহণ করেন এবং আনিল আম্বানি ১৯৫৯ সালে। তারা উভয়েই মুম্বাইতে বড় হয়েছেন এবং তাদের বাবা ধীরুভাই আম্বানি রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজ প্রতিষ্ঠা করেন। মুকেশের শিক্ষাজীবন শুরু হয় মুম্বাই বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং পরে তিনি স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে এমবিএ করতে যান। তবে, তিনি পড়াশোনা অসমাপ্ত রেখে ভারতে ফিরে আসেন এবং বাবার ব্যবসায় যোগ দেন। আনিল আম্বানি তার পড়াশোনা সম্পন্ন করেন যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়ারটন স্কুল থেকে এবং অর্থনীতিতে ডিগ্রি অর্জন করেন।
রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজ: শুরু থেকে শীর্ষে
ধীরুভাই আম্বানি ১৯৬০-এর দশকে রিলায়েন্স প্রতিষ্ঠা করেন। শুরুতে এটি ছিল একটি ছোট ব্যবসা, কিন্তু ধীরুভাইয়ের দূরদর্শী নেতৃত্ব ও কৌশলগত ব্যবসায়িক দৃষ্টিভঙ্গির ফলে রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজ এক সময় ভারতের বৃহত্তম শিল্পসমূহের একটি হয়ে ওঠে। রিলায়েন্স মূলত পেট্রোকেমিক্যালস, টেলিকম, রিটেল, এবং শক্তি খাতের ব্যবসায় বিশিষ্ট। মুকেশ ও আনিল, উভয়েই এই কোম্পানির উত্তরাধিকারী হওয়ার জন্য বাবার কাছ থেকে প্রশিক্ষণ নেন এবং কৌশলগত সিদ্ধান্তগুলোতে অংশগ্রহণ করেন।
ধীরুভাইয়ের মৃত্যুর পর: দন্দের শুরু
২০০২ সালে ধীরুভাই আম্বানির মৃত্যুর পর রিলায়েন্সের উপর মালিকানা নিয়ে মুকেশ ও আনিলের মধ্যে পারিবারিক দ্বন্দ্বের সূচনা হয়। তাদের বাবার জীবদ্দশায় কোনো লিখিত উত্তরাধিকার পরিকল্পনা ছিল না, যা তাদের মধ্যে বিভাজনের প্রধান কারণ হয়ে ওঠে। একাধিক আইনি ও পারিবারিক পরামর্শের পর ২০০৫ সালে মা কোকিলাবেন আম্বানি দুই ভাইয়ের মধ্যে কোম্পানির বিভাজন করেন। এই বিভাজনের ফলে মুকেশ আম্বানি রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজের (পেট্রোকেমিক্যাল, তেল, গ্যাস) নিয়ন্ত্রণ পান এবং আনিল আম্বানি রিলায়েন্স কমিউনিকেশনস (টেলিকম, এন্টারটেইনমেন্ট) ও অন্য কয়েকটি ব্যবসায়ের মালিকানা পান।
ব্যবসায়িক পার্থক্য ও প্রতিদ্বন্দ্বিতা
মুকেশ আম্বানি এবং আনিল আম্বানির ব্যবসায়িক দৃষ্টিভঙ্গি ও পরিচালনার কৌশল ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। মুকেশ তার নেতৃত্বে রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজকে বহুগুণে সম্প্রসারণ করেন এবং বিভিন্ন ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে সফলভাবে প্রবেশ করেন। রিলায়েন্স জিও লঞ্চের মাধ্যমে তিনি ভারতের টেলিকম ক্ষেত্রে বিপ্লব ঘটান। অন্যদিকে, আনিল আম্বানির বেশ কয়েকটি বড় প্রকল্প, যেমন রিলায়েন্স কমিউনিকেশনস এবং রিলায়েন্স ক্যাপিটাল, আর্থিক সংকটে পড়ে। তার কোম্পানিগুলো এক সময়ে সফল ছিল, কিন্তু ঋণ বৃদ্ধি ও অপারেশনাল চ্যালেঞ্জের কারণে তিনি বেশ কিছু আইনি সমস্যায় পড়েন।
পারিবারিক সম্পর্কের টানাপড়েন
ভাইদের মধ্যে দন্দ শুধু ব্যবসায়িক নয়, এটি ব্যক্তিগত পর্যায়েও পৌঁছায়। মুকেশ এবং আনিলের মধ্যে ব্যবসার পাশাপাশি ব্যক্তিগত সম্পর্কও শীতল হয়ে ওঠে। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তাদের একসাথে দেখা না যাওয়া এবং পরিবারের মধ্যে দূরত্ব তৈরি হওয়ায় মানুষদের মধ্যে সন্দেহ বাড়ে। মিডিয়াতে অনেক সময় তাদের সম্পর্কের বিভিন্ন ঘটনার উল্লেখ পাওয়া যায়, যা পরিবারটিকে বারবার আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে আসে।
মুকেশ ও আনিলের বর্তমান সম্পর্ক
সম্প্রতি, কিছু ক্ষেত্রে এই দুই ভাই আবার কাছাকাছি এসেছেন। যেমন আনিল আম্বানি যখন ঋণের চাপে পড়ে এবং তাকে আইনি জটিলতার সম্মুখীন হতে হয়, তখন মুকেশ আম্বানি তার সাহায্য করেন। ২০১৯ সালে, চীনের একটি ব্যাংকের কাছে আনিল আম্বানি বিপুল ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়লে মুকেশ তার ঋণ পরিশোধে সাহায্য করেন। এতে দুই ভাইয়ের সম্পর্কের উন্নতির আশা দেখা যায়। তবে তারা এখনও স্বতন্ত্রভাবে তাদের নিজ নিজ ব্যবসা পরিচালনা করেন এবং সম্পূর্ণ ভিন্ন পথ অনুসরণ করেন।
উপসংহার
মুকেশ ও আনিল আম্বানির দন্দ ভারতীয় কর্পোরেট জগতের সবচেয়ে আলোচিত বিষয়গুলোর একটি। পারিবারিক সমৃদ্ধি ও ঐতিহ্যের পাশাপাশি, তাদের মধ্যকার এই দ্বন্দ্ব শিক্ষণীয় হিসেবে উঠে আসে। ধীরুভাই আম্বানির ব্যবসার উত্তরাধিকার কিভাবে দুই ভাইয়ের ভিন্ন ব্যবসায়িক দৃষ্টিভঙ্গি ও ব্যক্তিত্বের মাধ্যমে প্রভাবিত হয়েছে, তা তাদের জীবন ও কর্মজীবনের প্রতিচ্ছবি হয়ে রয়েছে। যদিও তাদের পারিবারিক সম্পর্ক অনেকবার সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে, তবুও তাদের একে অপরের প্রতি সহানুভূতি এবং কিছু ক্ষেত্রে সহায়তায় তারা আবার একতাবদ্ধ হয়েছে।
এই সম্পর্ক থেকে বোঝা যায় যে, ব্যক্তিগত ও ব্যবসায়িক সম্পর্কের মধ্যে ভারসাম্য রাখা কতটা গুরুত্বপূর্ণ এবং এটি শুধুমাত্র অর্থ ও ক্ষমতার উপর নির্ভর করে না, বরং মানবিকতা, দায়িত্ববোধ এবং পরিবারের প্রতি সম্মানের উপরও নির্ভরশীল।
0 মন্তব্যসমূহ