পার্বত্য চট্টগ্রাম সংঘাত (১৯৭৭-১৯৯৭)


পার্বত্য চট্টগ্রাম সংঘাত
ছিল বাংলাদেশে এক দীর্ঘস্থায়ী এবং জটিল জাতিগত ও রাজনৈতিক সংঘর্ষ, যা ১৯৭৭ সাল থেকে শুরু হয়ে ১৯৯৭ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি (পিস চুক্তি) স্বাক্ষরের মাধ্যমে শেষ হয়। এই সংঘর্ষে মূলত বান্দরবান, রাঙ্গামাটি, এবং খাগড়াছড়ি জেলার পাহাড়ি এলাকার বাঙালি এবং পাহাড়ি উপজাতি জনগণের মধ্যে এক বৃহত্তর সংঘর্ষের পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল। সংঘর্ষের কারণে বিপুল সংখ্যক মানুষের জীবন ও সম্পদের ক্ষতি হয় এবং বহু বছর ধরে এর সামাজিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক প্রভাব বাংলাদেশে ছিল।

সংঘাতের পটভূমি

১. উপজাতি জনগণের জাতিগত এবং সাংস্কৃতিক পরিচিতি
পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতি জনগণ প্রধানত চাকমা, ত্রিপুরা, মার্মা, মুরং, ওয়াইয়ান, খিয়া ইত্যাদি জাতিগোষ্ঠীর লোকদের নিয়ে গঠিত। এসব জনগণের নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্য রয়েছে, যা বাঙালি সংস্কৃতি থেকে ভিন্ন। স্বাধীনতার পর, বাংলাদেশে বাঙালি সংস্কৃতির আধিপত্য বাড়তে থাকে, যা পার্বত্য অঞ্চলের উপজাতি জনগণের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি করে।

২. বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর পরিস্থিতি
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম চলাকালে পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি জনগণ অধিকাংশই পাকিস্তানের পক্ষে সমর্থন জানায়। স্বাধীনতার পর, বাংলাদেশ সরকার পার্বত্য অঞ্চলে বাঙালি শরণার্থীদের পুনর্বাসনের জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করতে থাকে। এতে স্থানীয় পাহাড়ি জনগণের মধ্যে তাদের ভূমি ও সাংস্কৃতিক পরিচিতির প্রতি উদ্বেগ সৃষ্টি হয়। বাঙালি শরণার্থীদের পুনর্বাসন এবং রাষ্ট্রীয় আধিপত্য বাড়ানোর ফলে উপজাতি জনগণের মধ্যে আস্থা সংকট তৈরি হয়।

সংঘাতের কারণ

১. ভূমি অধিকার এবং পুনর্বাসন
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর পার্বত্য চট্টগ্রামে বহু বাঙালি শরণার্থী পুনর্বাসিত হয়, যা স্থানীয় পাহাড়ি জনগণের ভূমি অধিকার নিয়ে সমস্যা সৃষ্টি করে। পাহাড়ি জনগণের lands বা জমি হারানোর ভয় এবং তাদের সাংস্কৃতিক পরিচয়ের ক্ষতি নিয়ে তারা গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে।

২. রাষ্ট্রীয় নীতির প্রতি অসন্তোষ
বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামে সরকারিভাবে ভূমি পুনর্বাসন প্রকল্প এবং বাঙালি জনগণের বসবাসের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল। এই নীতির কারণে পাহাড়ি জনগণ মনে করেছিল যে তাদের ঐতিহ্যবাহী ভূমি এবং সাংস্কৃতিক অধিকার হুমকির মুখে পড়েছে।

৩. অস্ত্রবাজদের উত্থান
পাহাড়ি জনগণের মধ্যে জাতিগত ও সাংস্কৃতিক বৈষম্য বেড়ে গেলে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনযুদ্ধ দল (পিসিজিএফ) গঠন হয়। এটি ছিল একটি মাওবাদী গোষ্ঠী, যা পাহাড়ি জনগণের অধিকারের জন্য সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু করে।

সংঘর্ষের প্রক্রিয়া

১. প্রাথমিক প্রতিবাদ
পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি জনগণ প্রথমদিকে শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ এবং রাজনৈতিক কর্মসূচি গ্রহণ করেছিল, তবে ধীরে ধীরে তা সশস্ত্র সংগ্রামে পরিণত হয়। চাকমা জনগণের নেতৃত্বে একটি সংগঠন জাতীয় পাহাড়ি পার্টি গঠন করা হয়, যা পরবর্তীতে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনযুদ্ধ বাহিনী হিসেবে পরিচিত হয়।

২. বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রতিক্রিয়া
পাহাড়ি জনগণের সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু হলে বাংলাদেশ সরকার এবং সেনাবাহিনী কঠোর পদক্ষেপ নিতে শুরু করে। সরকার তাদের বিরুদ্ধে অপারেশন ইউনিক্স নামে সামরিক অভিযান শুরু করে, যা অনেকটা জোরপূর্বক দমন-পীড়নমূলক ছিল। এই অভিযানের ফলে উভয় পক্ষের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষের সৃষ্টি হয়, এবং স্থানীয় জনগণের মধ্যে এক ধরনের রাজনৈতিক ও জাতিগত বিভাজন তৈরি হয়।

৩. মানবাধিকার লঙ্ঘন
যুদ্ধের সময় উভয় পক্ষই মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে। সেনাবাহিনী এবং বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী উভয়ই স্থানীয় জনগণের বিরুদ্ধে সহিংসতা এবং নির্যাতন চালিয়েছিল, যার ফলে সাধারণ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল।

চুক্তি ও সমাধান

১. পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তি (১৯৯৭)
১৯৯৭ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তি বা পিস চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, যা সংঘর্ষের অবসান ঘটায়। বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে জাতীয় পাহাড়ি পার্টি বা জেএসএস (Jumma Surrendered Socialist) এবং অন্যান্য উপজাতি সংগঠনগুলোর মধ্যে এই চুক্তি হয়।

২. চুক্তির মূল শর্তাবলী
পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তির মাধ্যমে সরকার পাহাড়ি জনগণের অধিকার স্বীকৃতি, তাদের ভূমির উপর কর্তৃত্ব নিশ্চিত এবং নিজস্ব সাংস্কৃতিক পরিচয় রক্ষার ব্যবস্থা গ্রহণ করে। চুক্তির মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামের সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর অস্ত্র সমর্পণের জন্য সম্মতি দেয় এবং শান্তি প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে সীমান্ত চুক্তি রূপরেখা নির্ধারণ করা হয়।

৩. চুক্তির ফলাফল
পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তির ফলে বেশ কিছু ইতিবাচক পরিবর্তন আসে, যেমন:

  • সেনাবাহিনী প্রত্যাহার
  • পাহাড়ি জনগণের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার সংরক্ষণ
  • আঞ্চলিক কাউন্সিল গঠন
    তবে চুক্তির পরও পুরোপুরি শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়নি, কারণ কিছু গোষ্ঠী চুক্তি মেনে না নিয়ে সহিংস কার্যক্রম চালিয়ে গেছে। তবে, চুক্তিটি শান্তির দিকে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে চিহ্নিত হয়।

সংঘাতের ফলাফল

১. মানবিক প্রভাব
পার্বত্য চট্টগ্রাম সংঘাতে বহু নিরীহ মানুষ প্রাণ হারিয়েছে, এবং বিশাল সংখ্যক মানুষ ঘরছাড়া হয়েছে। শরণার্থী পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়, যার ফলে স্থানীয় জনগণের জীবনে মারাত্মক প্রভাব পড়ে।

২. রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবর্তন
পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি প্রতিষ্ঠার পর, স্থানীয় জনগণের মধ্যে রাজনৈতিক সম্প্রীতি বৃদ্ধি পায়, তবে আঞ্চলিক ও জাতিগত উত্তেজনা সম্পূর্ণরূপে নির্মূল হয়নি। পাহাড়ি জনগণের মধ্যে একটি আলাদা জাতিগত পরিচয় এবং সাংস্কৃতিক অধিকার বজায় থাকে, যা এখনো প্রাধান্য পায়।

৩. অর্থনৈতিক ক্ষতি
বহু বছরের সংঘর্ষের কারণে পার্বত্য চট্টগ্রামের অর্থনীতি ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কৃষি, বাণিজ্য এবং অন্যান্য স্থানীয় শিল্পের উৎপাদন ব্যাহত হয়, এবং অনেক কাঠামোগত উন্নয়ন বিলম্বিত হয়।

উপসংহার

পার্বত্য চট্টগ্রাম সংঘাত ছিল বাংলাদেশে এক দীর্ঘমেয়াদী এবং গম্ভীর জাতিগত ও রাজনৈতিক সমস্যা, যা ১৯৭৭ থেকে ১৯৯৭ পর্যন্ত চলতে থাকে। পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তির মাধ্যমে এই সংঘর্ষের অবসান ঘটানো হয়, তবে এর মানবিক, রাজনৈতিক এবং সামাজিক প্রভাব বাংলাদেশে এখনও অনুভূত হয়। এই সংঘাত বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হিসেবে স্থান পেয়েছে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ