১ম বিশ্বযুদ্ধ ইতিহাসের এক বিপ্লবী অধ্যায়, যা ১৯১৪ থেকে ১৯১৮ সাল পর্যন্ত চলেছিল। যদিও এটি সরাসরি সরায়েভো হত্যাকাণ্ড থেকে শুরু হয়, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে যুদ্ধের পিছনে ছিল বহু বছর ধরে জমে থাকা রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক প্রতিযোগিতা। হত্যাকাণ্ড কেবল এই স্ফুলিঙ্গকে শিখায় পরিণত করেছিল।
যুদ্ধের পটভূমি
যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে ইউরোপের দেশগুলোর মধ্যে কয়েকটি প্রধান কারণ দ্বন্দ্বের ক্ষেত্র তৈরি করেছিল:
জাতীয়তাবাদ:
ইউরোপে উগ্র জাতীয়তাবাদের উত্থান ঘটে। বিশেষত, বলকান অঞ্চলকে "ইউরোপের পাউডার কেগ" বলা হত, যেখানে সার্বিয়ান জাতীয়তাবাদ অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি সাম্রাজ্যের জন্য বড় হুমকি হয়ে ওঠে।সামরিক প্রতিযোগিতা:
ইউরোপের বড় শক্তিগুলোর মধ্যে সামরিক শক্তি বৃদ্ধির প্রতিযোগিতা তীব্র হয়। বিশেষত ব্রিটেন এবং জার্মানির মধ্যে নৌবাহিনী শক্তিশালী করার দৌড় চলছিল।জোট রাজনীতি:
ইউরোপের দেশগুলো নিজেদের মধ্যে দুটি প্রধান জোটে বিভক্ত হয়েছিল:- ট্রিপল অ্যালায়েন্স: জার্মানি, অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি, এবং ইতালি।
- ট্রিপল অ্যান্টেন্ট: ব্রিটেন, ফ্রান্স, এবং রাশিয়া।
এই জোটগুলো যুদ্ধের আগুনকে দ্রুত ছড়িয়ে দিতে ভূমিকা রাখে।
উপনিবেশবাদ:
আফ্রিকা ও এশিয়ার উপনিবেশ নিয়ে প্রতিযোগিতা ইউরোপীয় দেশগুলোর মধ্যে শত্রুতা বাড়ায়।
সরায়েভো হত্যাকাণ্ড এবং যুদ্ধের স্ফুলিঙ্গ
২৮ জুন, ১৯১৪, বসনিয়ার সরায়েভো শহরে আর্চডিউক ফ্রান্ৎস ফার্ডিনান্ড এবং তার স্ত্রীকে হত্যা করা হয়। হত্যাকারী ছিল সার্বিয়ান জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠী ব্ল্যাক হ্যান্ড-এর সদস্য গ্যাভ্রিলো প্রিন্সিপ।
এই ঘটনাটি অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরিকে মারাত্মকভাবে ক্ষুব্ধ করে তোলে। তারা সার্বিয়াকে সরাসরি দায়ী করে এবং এই হত্যাকাণ্ডকে যুদ্ধ ঘোষণার জন্য ব্যবহার করে।
যুদ্ধ শুরু হওয়ার প্রক্রিয়া
সরায়েভো হত্যাকাণ্ডের পরপরই ইউরোপে পরস্পর সম্পর্কিত একটি ধারাবাহিক ঘটনা ঘটে, যা যুদ্ধের দিকে নিয়ে যায়:
অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরির আলটিমেটাম (২৩ জুলাই, ১৯১৪):
হত্যাকাণ্ডের এক মাস পর, অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি সার্বিয়াকে ১০ দফা শর্ত সম্বলিত একটি আলটিমেটাম পাঠায়। সার্বিয়া বেশিরভাগ শর্ত মেনে নেয়, কিন্তু কয়েকটি শর্ত তাদের সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকি বলে মনে করে।অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরির যুদ্ধ ঘোষণা (২৮ জুলাই, ১৯১৪):
সার্বিয়ার প্রতিক্রিয়ায় অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি সার্বিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে।রাশিয়ার প্রতিক্রিয়া:
সার্বিয়া রাশিয়ার স্লাভিক মিত্র হওয়ায় রাশিয়া সরাসরি তাদের সমর্থনে আসে এবং অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরির বিরুদ্ধে সেনা মোতায়েন শুরু করে।জার্মানির পদক্ষেপ:
অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরির ঘনিষ্ঠ মিত্র জার্মানি, রাশিয়ার সেনা মোতায়েনকে যুদ্ধের আহ্বান হিসেবে বিবেচনা করে। ১ আগস্ট, ১৯১৪, জার্মানি রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে।ফ্রান্সের জড়িত হওয়া:
জার্মানির আরেক শত্রু ফ্রান্স, রাশিয়ার সঙ্গে জোটবদ্ধ ছিল। ৩ আগস্ট, ১৯১৪, জার্মানি ফ্রান্সের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে।বেলজিয়াম আক্রমণ এবং ব্রিটেনের প্রবেশ:
জার্মানি, ফ্রান্সকে আক্রমণ করার জন্য নিরপেক্ষ বেলজিয়াম হয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা (শ্লিফেন পরিকল্পনা) গ্রহণ করে। বেলজিয়ামের নিরপেক্ষতা লঙ্ঘন করায় ব্রিটেন জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে।ওসমান সাম্রাজ্য ও অন্যান্য দেশ:
ওসমান সাম্রাজ্য এবং বুলগেরিয়া জার্মানির পক্ষে যোগ দেয়, অন্যদিকে ইতালি, জাপান, এবং পরবর্তীতে যুক্তরাষ্ট্র মিত্রশক্তির পক্ষে লড়াইয়ে যোগ দেয়।
যুদ্ধ শুরুর চেইন অব ইভেন্টস (সময়রেখা)
তারিখ | ঘটনা |
---|---|
২৮ জুন, ১৯১৪ | সরায়েভো হত্যাকাণ্ড |
২৩ জুলাই, ১৯১৪ | অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরির সার্বিয়াকে আলটিমেটাম |
২৮ জুলাই, ১৯১৪ | অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরির সার্বিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা |
১ আগস্ট, ১৯১৪ | জার্মানির রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা |
৩ আগস্ট, ১৯১৪ | জার্মানির ফ্রান্সের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা |
৪ আগস্ট, ১৯১৪ | ব্রিটেনের জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা |
যুদ্ধের ফলাফল
১. মানবিক ক্ষয়ক্ষতি
১ম বিশ্বযুদ্ধে প্রায় ২ কোটি মানুষ মারা যায় এবং আরও কয়েক কোটি আহত হয়। যুদ্ধে সরাসরি নিহতের পাশাপাশি দুর্ভিক্ষ, রোগ, এবং গৃহহীনতার কারণে অসংখ্য মানুষের মৃত্যু হয়।
২. অর্থনৈতিক প্রভাব
- ইউরোপের ধ্বংস: ইউরোপীয় দেশগুলোর অর্থনীতি দুর্বল হয়ে পড়ে। ব্রিটেন এবং ফ্রান্স তাদের ঋণ শোধে ব্যর্থ হয়, এবং যুক্তরাষ্ট্র একটি অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়।
- জার্মান অর্থনীতি ধ্বংস: ভার্সাই চুক্তির শর্ত অনুযায়ী জার্মানিকে বিশাল ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য করা হয়, যা তার অর্থনীতিকে ভেঙে দেয়।
৩. রাজনৈতিক পরিবর্তন
- রাজতন্ত্রের পতন: জার্মানি, রাশিয়া, এবং অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরির রাজতন্ত্র ভেঙে পড়ে।
- নতুন রাষ্ট্রের উদ্ভব: পোল্যান্ড, চেকোস্লোভাকিয়া, এবং যুগোস্লাভিয়ার মতো নতুন দেশ গঠিত হয়।
৪. ভার্সাই চুক্তি (১৯১৯)
- মিত্রশক্তি এবং জার্মানির মধ্যে এই চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।
- জার্মানিকে যুদ্ধের জন্য দায়ী করা হয় এবং তার সামরিক শক্তি সীমিত করা হয়।
- ওসমান সাম্রাজ্যের অধিকাংশ অঞ্চল মিত্রশক্তির মধ্যে ভাগ করে নেওয়া হয়।
৫. আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিষ্ঠা
১ম বিশ্বযুদ্ধের পর ভবিষ্যতে এমন সংঘাত প্রতিরোধের জন্য লীগ অব নেশনস গঠন করা হয়। তবে এটি কার্যকর ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হয়, যা ২য় বিশ্বযুদ্ধের পথে মঞ্চ প্রস্তুত করে।
৬. সামাজিক প্রভাব
- যুদ্ধের সময় নারীরা পুরুষদের অনুপস্থিতিতে কারখানা ও অফিসে কাজ শুরু করে, যা পরবর্তীতে নারীর অধিকারের আন্দোলনকে ত্বরান্বিত করে।
- সাধারণ মানুষ যুদ্ধের ধ্বংসযজ্ঞ দেখে শান্তির গুরুত্ব নতুন করে উপলব্ধি করে।
উপসংহার
১ম বিশ্বযুদ্ধের শুরু হওয়ার প্রক্রিয়া ছিল একটি ধাপে ধাপে বিকাশমান সংকট, যেখানে জাতীয়তাবাদ, সামরিক প্রতিযোগিতা, এবং রাজনৈতিক জোটগুলোর ভূমিকা ছিল অপরিসীম। সরায়েভো হত্যাকাণ্ড সেই ঘটনাগুলোর ট্রিগার হিসেবে কাজ করেছিল, যা কয়েক দশক ধরে জমে থাকা শত্রুতা এবং কূটনৈতিক ব্যর্থতাগুলোর কারণে একটি বিশ্বযুদ্ধে রূপান্তরিত হয়।
0 মন্তব্যসমূহ