ইসকন বা "ইন্টারন্যাশনাল সোসাইটি ফর কৃষ্ণা কনশাসনেস" (ISKCON) মূলত একটি হিন্দু ধর্মীয় সংগঠন, যা ১৯৬৬ সালে শ্রীল প্রভুপাদ প্রতিষ্ঠা করেন। শ্রীল প্রভুপাদ (ভক্তিবেদান্ত স্বামী) একজন বঙ্গদেশীয় আধ্যাত্মিক গুরু ও গৌড়ীয় বৈষ্ণব দর্শনের প্রচারক ছিলেন। আমেরিকার নিউইয়র্কে এই সংস্থার সূচনা হয়েছিল এবং পরবর্তীতে এটি দ্রুত বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ে। ইসকনের প্রধান দর্শন গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মের ভিত্তিতে কৃষ্ণের পূজা ও ভক্তিমূলক চর্চা এবং "হরে কৃষ্ণ" মহামন্ত্রের জপ। ইসকন মূলত শ্রীমদ্ভাগবত ও ভগবদ্গীতার উপর নির্ভর করে ভক্তির এই ধারাকে প্রচার করে।
কার্যক্রম ও কাজ
ইসকনের লক্ষ্য হল কৃষ্ণভাবনা বা কৃষ্ণচেতনা প্রচার করা এবং কৃষ্ণের প্রতি মানুষের আস্থা জাগানো। তাদের মূল কার্যক্রমগুলির মধ্যে রয়েছে মন্দির নির্মাণ, পুস্তক প্রকাশনা, শিক্ষা প্রচার, ফুড ফর লাইফ প্রোগ্রাম (যার মাধ্যমে বিনামূল্যে খাবার বিতরণ করা হয়), এবং আধ্যাত্মিক শিক্ষার ব্যবস্থা। ইসকন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছে যেখানে ভগবদ গীতার শিক্ষাসহ হিন্দু ধর্মীয় গ্রন্থগুলির উপদেশ শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রচারিত হয়। তাদের অনেক মন্দিরে সঙ্গীত ও নৃত্যের মাধ্যমে ভক্তিগীতির অনুষ্ঠান করা হয়, যা কৃষ্ণের ভক্তিতে ভরপুর একটি পরিবেশ সৃষ্টি করে।
ইসকন সম্পর্কিত বিতর্কিত বিষয়সমূহ
ইসকন প্রতিষ্ঠার পর থেকেই বিভিন্ন বিতর্কের সম্মুখীন হয়েছে। এর মধ্যে কিছু মূল বিতর্কের বিষয় নিম্নরূপ:
১. গুরু বিতর্ক: প্রভুপাদের মৃত্যুর পর, ইসকনের ভক্তরা নতুন গুরুদের মেনে নেন, যা গুরুবাদ সম্পর্কিত বিভিন্ন মতপার্থক্য তৈরি করে। এতে ইসকনের অভ্যন্তরে গুরুদের প্রতি আস্থা নিয়ে মতবিরোধ সৃষ্টি হয়। প্রভুপাদ নির্দেশ দিয়েছিলেন তার মৃত্যুর পরেও তার নির্দেশিত শিক্ষাগুলি মেনে চলতে এবং তার প্রতি ভক্তিশ্রদ্ধা রাখতে।
২. সম্প্রদায়ের ভিতর ক্ষমতার দ্বন্দ্ব: প্রতিষ্ঠাতার মৃত্যুর পর নেতৃত্বের মধ্যে বিভাজন দেখা দেয়। অনেকক্ষেত্রে ভক্তরা নতুন নেতৃত্বে অপ্রসন্ন হয়ে পড়েন। ইসকনের ভিতরে অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক কূটকৌশল এবং ক্ষমতার লড়াই সম্পর্কে অভিযোগ উঠেছে।
৩. আর্থিক স্বচ্ছতার অভাব: ইসকনের বড় বড় মন্দির ও প্রকল্পে বিপুল অর্থব্যয় হয়। অর্থ ব্যবহারের স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে এবং কিছু ক্ষেত্রেই অপব্যবহারের অভিযোগ ওঠে।
৪. যৌন কেলেঙ্কারি: ইসকনের বেশ কয়েকজন উচ্চপদস্থ সদস্য যৌন কেলেঙ্কারির সাথে যুক্ত ছিলেন, যা ইসকনের সম্মানকে ক্ষুণ্ণ করেছে। কিছু মন্দিরের সদস্যদের বিরুদ্ধে শিশুদের সঙ্গে অশালীন ব্যবহার ও নির্যাতনের অভিযোগও রয়েছে।
৫. সম্প্রসারণের বিতর্ক: ইসকন তার প্রচার কার্যক্রম ও দাতব্য কাজগুলির মাধ্যমে বহু স্থানে প্রভাব বিস্তার করেছে। তবে এর মাধ্যমে স্থানীয় ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক মূল্যবোধের সঙ্গে সংঘর্ষেরও অভিযোগ উঠেছে।
উপসংহার
ইসকন, শ্রীকৃষ্ণ ভক্তি এবং আধ্যাত্মিক চেতনা প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। অনেক বিতর্কের মুখে পড়েও ইসকন বিশ্বজুড়ে একটি শক্তিশালী সংগঠন হিসেবে টিকে রয়েছে এবং কৃষ্ণভাবনা প্রচারের মাধ্যমে বহু মানুষের জীবনে আধ্যাত্মিকতার আলো নিয়ে এসেছে। বিতর্কিত ঘটনাগুলির উপর আরও সচেতনতা এবং স্বচ্ছতার দিকে নজর দিলে ইসকন তার মূল উদ্দেশ্যের দিকে আরও এগিয়ে যেতে পারে এবং ভবিষ্যতে ভক্ত ও সাধারণ জনগণের আস্থা পুনরুদ্ধার করতে পারে।
0 মন্তব্যসমূহ