১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ পর্যন্ত বাংলাদেশের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ও সামাজিক ঘটনা ছিল কমিউনিস্ট বিপ্লব। এই সময়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বিভিন্ন সমাজতান্ত্রিক ও কমিউনিস্ট আন্দোলন তীব্র হয়ে উঠেছিল। একদিকে যেখানে মুক্তিযুদ্ধের পর দেশ পুনর্গঠনের চেষ্টা চলছিল, অন্যদিকে সমাজতান্ত্রিক আদর্শ প্রতিষ্ঠার জন্য বিভিন্ন গোষ্ঠী সক্রিয় ছিল। এই সময়কালে বাংলাদেশের রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ব্যাপক অস্থির ছিল, এবং কমিউনিস্টদের কর্মকাণ্ড তা আরও জটিল করে তুলেছিল।
বিপ্লবের পটভূমি
১. স্বাধীনতার পরবর্তী পরিস্থিতি
বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জনের পর ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে পাকিস্তান থেকে মুক্তির পর দেশটিতে রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক পুনর্গঠন কাজ শুরু হয়। তবে, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থা ছিল অত্যন্ত শোচনীয়। দেশটির পুনর্গঠন, অর্থনৈতিক উন্নতি এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য বিশাল চ্যালেঞ্জ ছিল। এমন পরিস্থিতিতে, কমিউনিস্ট দলগুলো একটি শক্তিশালী সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করার জন্য সক্রিয় হয়ে ওঠে।
২. কমিউনিস্ট আদর্শের প্রসার
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে মাওবাদী এবং কমিউনিস্ট আদর্শের প্রতি সমর্থন ছিল। বিশেষ করে, ভারতের বামপন্থী দলগুলো এবং পশ্চিমা বিশ্বের কিছু দেশ সমাজতান্ত্রিক আদর্শকে সমর্থন করেছিল। মুক্তিযুদ্ধের পর, এসব আদর্শ গ্রহণকারী গোষ্ঠীগুলো বাংলাদেশে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ শুরু করে।
৩. আন্তর্জাতিক প্রভাব
১৯৭২ সাল নাগাদ, সারা বিশ্বে সমাজতান্ত্রিক এবং বামপন্থী আন্দোলনগুলোর ব্যাপক প্রসার ঘটে। বিশেষ করে, সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং চীন বাংলাদেশে কমিউনিস্ট আন্দোলনের প্রতি সমর্থন জানায়, যা বাংলাদেশের কমিউনিস্ট দলগুলোর তৎপরতাকে উৎসাহিত করে।
বিপ্লবের কারণ
১. রাজনৈতিক অস্থিরতা
১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ পর্যন্ত বাংলাদেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা ছিল ব্যাপক। জাতীয় সরকারে বিরোধী দলগুলোর অংশগ্রহণ ছিল কম এবং ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ সরকারও নানা ধরনের চাপের মধ্যে ছিল। এই পরিস্থিতি কমিউনিস্ট দলের জন্য কার্যক্রম পরিচালনা করতে উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করে।
২. অর্থনৈতিক দুরাবস্থা
দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা ছিল চরম দুরাবস্থায়। খাদ্যাভাব, মুদ্রাস্ফীতি, এবং দারিদ্র্য ছিল তীব্র। এসব সমস্যায় জনসাধারণের মধ্যে ক্ষোভ বাড়তে থাকে এবং অনেকেই সমাজতান্ত্রিক বা কমিউনিস্ট আদর্শে আশ্রয় নেয়, যা সরকার বিরোধী আন্দোলনে রূপ নেয়।
৩. সমাজতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষা
কমিউনিস্ট দলগুলো একটি নিরপেক্ষ ও বৈষম্যমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছিল। তারা সমাজের সম্পদ সমানভাবে বণ্টন এবং শোষণের অবসান চেয়েছিল। এই উদ্দেশ্যে তারা রাজনৈতিক, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক সংস্কারের দাবি তুলেছিল।
বিপ্লবের প্রক্রিয়া
১. কমিউনিস্ট গোষ্ঠীগুলোর সক্রিয়তা
বিপ্লবী কমিউনিস্ট গোষ্ঠীগুলো, বিশেষ করে বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী-লেনিনবাদী) এবং মাওবাদী গোষ্ঠী সরকার বিরোধী কার্যক্রমে যুক্ত হতে থাকে। তারা প্রাথমিকভাবে কৃষক আন্দোলন, শ্রমিক আন্দোলন এবং শহরে প্রতিবাদ আন্দোলনের মাধ্যমে তাদের আদর্শের প্রচার চালায়। এই সময়ে বাংলাদেশে বিপ্লবী চেতনার উত্থান ঘটে।
২. রাষ্ট্রের প্রতি চাপ সৃষ্টি
১৯৭৩ সাল নাগাদ, দেশের বিভিন্ন অংশে গেরিলা আন্দোলন এবং মাওবাদী বিদ্রোহ শুরু হয়। বিশেষ করে, দেশের উত্তর-পূর্ব এবং দক্ষিণ-পূর্ব অংশে কমিউনিস্ট গোষ্ঠীগুলো শক্তিশালী হয়ে ওঠে এবং পার্টিজান যুদ্ধ শুরু করে। তারা সরকারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রাম ঘোষণা করে।
৩. সরকারের প্রতিক্রিয়া
বাংলাদেশ সরকার এই ধরনের আন্দোলন দমনের জন্য কঠোর পদক্ষেপ নেয়। সেনাবাহিনী এবং পুলিশ বাহিনী বিশেষ অভিযান চালিয়ে বিপ্লবী গোষ্ঠীগুলোর বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করে। পাশাপাশি, কমিউনিস্ট গোষ্ঠীগুলোর নেতা এবং সমর্থকদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তার এবং শাস্তির ব্যবস্থা করা হয়।
৪. সামরিক সরকার প্রতিষ্ঠা (১৯৭৫)
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডের পর, বাংলাদেশে এক সামরিক অভ্যুত্থান ঘটে। এই পরিস্থিতি কমিউনিস্ট বিপ্লবের কার্যক্রমে একটি পরিবর্তন আনে। সামরিক সরকার তাদের প্রতি অত্যন্ত কঠোর মনোভাব পোষণ করে এবং দেশে কমিউনিস্ট দল নিষিদ্ধ করা হয়।
বিপ্লবের ফলাফল
১. সরকারি দমন-পীড়ন
বিপ্লবী গোষ্ঠীগুলোর বিরুদ্ধে সরকারের দমন-পীড়ন ছিল অত্যন্ত তীব্র। কমিউনিস্ট দলের সদস্যরা গ্রেপ্তার এবং শাস্তি ভোগ করে। অনেক নেতাকে গণনা-যোগ্য পরিস্থিতিতে হত্যা করা হয় এবং দলের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়।
২. সামরিক শাসন প্রতিষ্ঠা
১৯৭৫ সালের আগস্টে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডের পর, বাংলাদেশের রাজনীতি আরও অস্থিতিশীল হয়ে ওঠে এবং সামরিক শাসনের সূচনা হয়। এই শাসনব্যবস্থা সমাজতান্ত্রিক আদর্শের প্রতি শত্রু মনোভাব পোষণ করে, ফলে কমিউনিস্ট দলগুলোর কার্যক্রম পুরোপুরি দমন করা হয়।
৩. কমিউনিস্ট আন্দোলনের পরাজয়
কমিউনিস্ট আন্দোলনটি একপ্রকার পরাজিত হয়, বিশেষত ১৯৭৫ সালের পর। সামরিক সরকারের শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর, বাংলাদেশে কমিউনিস্ট আন্দোলন কার্যত স্তব্ধ হয়ে যায়। তবে, ১৯৮০ সালের পর থেকে বাংলাদেশে কিছু সমাজতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল আবার কিছুটা জনপ্রিয়তা অর্জন করে, কিন্তু কমিউনিস্ট আন্দোলন আর আগের মতো প্রভাবশালী হতে পারেনি।
উপসংহার
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট বিপ্লব (১৯৭২-১৯৭৫) ছিল এক সংকটময় এবং অস্থির সময়। স্বাধীনতার পরের এই সময়কালে, দেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অস্থিরতা কমিউনিস্ট গোষ্ঠীগুলোর উত্থান ঘটিয়েছিল। যদিও তাদের আন্দোলনগুলি সামরিক শাসনের আগমনের পর ব্যর্থ হয়ে যায়, তবে তাদের সংগ্রাম বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত হয়।
0 মন্তব্যসমূহ