মুম্বাইয়ের কামাঠিপুরা, ভারতীয় ইতিহাসে এক উল্লেখযোগ্য নাম, যা দেশটির অন্যতম প্রাচীন যৌনপল্লী হিসেবে পরিচিত। কামাঠিপুরা শুধু একটি এলাকা নয়; এটি শতাব্দী-পুরনো যৌনকর্ম শিল্পের কেন্দ্র, যেখানে আজও হাজার হাজার মানুষ জীবনযাপন করছেন। বর্তমানে এলাকাটিতে নানা ধরনের কার্যক্রম চালু রয়েছে, যার মাধ্যমে এই অঞ্চলের মানুষের জীবনযাত্রায় ইতিবাচক পরিবর্তন আনার প্রচেষ্টা চলছে। আজ আমরা কামাঠিপুরার নামকরণ থেকে শুরু করে এটির বর্তমান অবস্থা পর্যন্ত বিস্তারিত আলোচনা করবো।
নামকরণের ইতিহাস: কামাঠিপুরার জন্ম ও উৎপত্তি
১৮ শতকের শেষের দিকে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের সময়ে মুম্বাইয়ের কামাঠিপুরার উৎপত্তি ঘটে। দক্ষিণ ভারতের "কামাঠি" সম্প্রদায়ের নামানুসারে এর নামকরণ করা হয়। কামাঠি সম্প্রদায়ের লোকেরা মূলত নির্মাণকর্মী ছিল, যারা মুম্বাইয়ের বিভিন্ন নির্মাণ কাজে ব্রিটিশদের সহায়তা করত। তাদের নাম অনুসারেই এলাকাটির নাম হয় "কামাঠিপুরা," যা পরবর্তীতে যৌনপল্লী হিসেবে পরিচিতি লাভ করে।
ব্রিটিশ আমল থেকে যৌনপল্লী হিসেবে গড়ে ওঠা কামাঠিপুরা
কামাঠিপুরাকে ব্রিটিশরা মূলত তাদের সৈন্যদের জন্য বিনোদন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলে। তখন থেকেই এই এলাকায় যৌনকর্ম কেন্দ্রিক কর্মসংস্থান শুরু হয়, যা ক্রমে বড় আকার ধারণ করে। নানা আর্থিক ও সামাজিক পরিস্থিতির কারণে ভারতীয় মহিলারা এখানে এসে যৌনকর্মে যুক্ত হন, এবং ধীরে ধীরে এটি মুম্বাইয়ের অন্যতম বড় যৌনপল্লীতে পরিণত হয়।
ঐতিহ্য এবং সাংস্কৃতিক মেলবন্ধন
ব্রিটিশ আমলের স্থাপত্য এবং কামাঠি সম্প্রদায়ের ঐতিহ্য এখনও কামাঠিপুরার সংস্কৃতিতে বিদ্যমান। বিভিন্ন ধর্ম এবং সম্প্রদায়ের মানুষের মেলবন্ধন কামাঠিপুরাকে এক অনন্য সাংস্কৃতিক কেন্দ্র হিসেবে চিহ্নিত করে। তবে এখানকার ঐতিহ্য মূলত যৌনকর্ম কেন্দ্রিক হলেও এটি স্থানীয়ভাবে কিছু ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পালনেও পরিচিত।
যৌনকর্ম এবং অর্থনৈতিক অবস্থা
কামাঠিপুরার প্রধান অর্থনৈতিক কার্যক্রম যৌনকর্ম। এখানে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ আসে এবং যৌনকর্মীদের জন্য এটি একটি প্রধান আয়ের উৎস। গড়ে প্রতি গ্রাহকের জন্য ৫০০ থেকে ৫,০০০ ভারতীয় রুপি (বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ৭০০ থেকে ৭,০০০ টাকা) পর্যন্ত চার্জ নেওয়া হয়, যা গ্রাহকের সামর্থ্য এবং সেবার ধরনের উপর নির্ভর করে। এই অঞ্চলের বহু পরিবার যৌনকর্মকে কেন্দ্র করে তাদের জীবিকা নির্বাহ করে থাকে।
যৌনকর্মীদের বয়স এবং পেশায় প্রবেশের পথ
কামাঠিপুরায় বিভিন্ন বয়সের নারী যৌনকর্মে নিয়োজিত। সাধারণত, এখানকার যৌনকর্মীরা ১৮ থেকে ৪০ বছর বয়সের মধ্যে হয়ে থাকে। তবে অনেকেই কম বয়সে এখানে এসে এই পেশায় যুক্ত হয়, বিশেষ করে যারা অর্থনৈতিক কষ্টে আছেন বা প্রতারণার শিকার হয়েছেন। বেশিরভাগ সময়, আর্থিক সংকট বা প্রতারণার ফাঁদে পড়ে এখানে আসতে বাধ্য হন।
কোথা থেকে যৌনকর্মীরা আসে?
এই এলাকায় কাজ করতে আসা নারীরা ভারতের বিভিন্ন প্রদেশ থেকে আসে। বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গ, ঝাড়খণ্ড, ওড়িশা, উত্তর প্রদেশ এবং বিহারের মতো রাজ্য থেকে অনেক নারী এখানে কাজ করতে আসেন। এছাড়া, বাংলাদেশ এবং নেপাল থেকেও অনেক নারী পাচারের মাধ্যমে এই পেশায় জড়িত হয়। আর্থিকভাবে দুর্বল, নিরুপায় এবং যাদের পরিবারে আয় রোজগারের অবস্থা সংকটাপন্ন, সেই নারীদের এখানে আসার প্রবণতা বেশি।
স্থানীয় নারীদের ভূমিকা এবং উপস্থিতি
কামাঠিপুরায় স্থানীয় মুম্বাইয়ের নারীদের চেয়ে বাইরে থেকে আসা নারীদের সংখ্যাই বেশি। বেশিরভাগ নারী আর্থিক সমস্যায় জর্জরিত হয়ে এখানে আসে এবং পরিস্থিতির কারণে তারা এই পেশায় জড়িয়ে পড়ে।
সরদারদের ভূমিকা এবং টাকার নামকরণ
কামাঠিপুরায় যৌনকর্মীদের উপর সরদারদের বিশেষ প্রভাব রয়েছে। সরদাররা সাধারণত এখানকার যৌনকর্মীদের নিরাপত্তা ও পরিচালনার দায়িত্ব পালন করে এবং তাদের আয়ের একটি অংশ সংগ্রহ করে। এই অর্থকে সাধারণত ‘হাফা’ বা ‘মালিকানা’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। সরদাররা যৌনকর্মীদের সুরক্ষা, গ্রাহক সংগ্রহ, এবং খরচ পরিচালনার কাজেও সহায়তা করে। সরদারদের প্রতি সপ্তাহে বা মাসিক ভিত্তিতে টাকা দিতে হয়, যা তাদের আয় থেকে সংগ্রহ করা হয়।
দালাল চক্র এবং পাচার চক্র
দালাল চক্র কামাঠিপুরায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। অনেক নারী এই দালালদের মাধ্যমে কামাঠিপুরায় আসেন, যাদের মধ্যে অনেকেই প্রতারণার শিকার হন। দালাল চক্র অনেক সময় গ্রামের দরিদ্র পরিবারগুলোর নারীদের প্রলোভন দেখিয়ে এখানে নিয়ে আসে। তারা সুন্দর জীবনের আশ্বাস দিয়ে তাদেরকে মুম্বাইতে এনে এই পেশায় জোরপূর্বক যুক্ত করে। কামাঠিপুরায় অনেক নারী এই চক্রের মাধ্যমে এসে দুঃখজনক পরিস্থিতির মুখোমুখি হন। দালালরা নারীদের বিভিন্ন প্রলোভন দিয়ে এখানে এনে তাদের সরদারদের কাছে হস্তান্তর করে।
উপসংহার
কামাঠিপুরা শুধু একটি যৌনপল্লী নয়, এটি একটি সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক ইতিহাসের ধারক। যৌনকর্মের মাধ্যমে অর্থনৈতিকভাবে সক্ষম হলেও, এখানকার মানুষ ধীরে ধীরে উন্নয়নের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। কামাঠিপুরার ইতিহাস, সংস্কৃতি, এবং পরিবর্তনের যাত্রা আমাদের সামনে একটি বিস্তৃত চিত্র তুলে ধরে যা সমাজের নানাদিক নিয়ে চিন্তা করার সুযোগ দেয়।
0 মন্তব্যসমূহ