সোনাগাছি: ইতিহাস ও বর্তমান পরিস্থিতি



সোনাগাছি কলকাতার অন্যতম বৃহত্তম লাল বাতির এলাকা এবং এটি বাংলাদেশের গার্লস' স্কুলের কাছে অবস্থিত। এখানে প্রায় ১০,০০০ যৌনকর্মী কাজ করেন, যারা বিভিন্ন অঞ্চলের দরিদ্র পরিবার থেকে আসেন। অনেক ক্ষেত্রে, নারীরা সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রতিকূলতার কারণে এই পেশায় প্রবেশ করেন।

সোনাগাছি নামকরণ

সোনাগাছি নামকরণের পেছনে দুটি প্রচলিত মত রয়েছে, যা এই এলাকার ইতিহাসের সাথে সম্পর্কিত।

১. সোনা গোজি নামক জমিদার

অনেক ইতিহাসবিদের মতে, সোনাগাছি নামটি এসেছে একজন প্রভাবশালী জমিদারের নাম থেকে, যাঁর নাম ছিল সোনা গোজি। তিনি এই অঞ্চলের জমি ও সম্পত্তির মালিক ছিলেন এবং তাঁর নামেই এলাকাটি পরিচিত হয়ে ওঠে। সোনা গোজি ছিলেন এই অঞ্চলে একটি উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব, এবং তার নাম থেকেই সোনাগাছি শব্দের উৎপত্তি বলে ধারণা করা হয়।

২. সোনার গাছ (সোনালী রঙের গাছ)
আরেকটি প্রচলিত মত অনুযায়ী, সোনাগাছি নামটি এসেছে এখানকার কিছু সোনালী রঙের গাছ থেকে, যা একসময় এই এলাকায় ব্যাপকভাবে দেখা যেত। স্থানীয় মানুষেরা এই গাছগুলোর রঙের জন্য এলাকাটির নাম সোনাগাছি রাখতে পারেন বলে অনুমান করা হয়।
এই দুই মতের মধ্যে প্রথমটি বেশি গ্রহণযোগ্য বলে অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন।

১৯শ শতকের প্রেক্ষাপট

সোনাগাছির বিকাশ শুরু হয় ১৯শ শতকের মাঝামাঝি সময়ে, যখন এখানে যৌন কর্মের জন্য স্থানীয়ভাবে প্রথা শুরু হয়। তখন অনেক পতিতা সেখানে আসে, যারা প্রধানত দরিদ্র পরিবার থেকে আসেন এবং বিভিন্ন সামাজিক কারণে এই পেশায় নিযুক্ত হন। ব্রিটিশ শাসনের সময়, এই এলাকা যৌন ব্যবসার জন্য বিশেষভাবে পরিচিত হয়ে ওঠে, এবং অনেক দালাল এবং ব্রোথেল মালিকরা তাদের নিয়ন্ত্রণে নেন।

স্বাধীনতার পর

ভারত স্বাধীন হওয়ার পর, সোনাগাছির পরিস্থিতি খুব একটা পরিবর্তিত হয়নি। এই এলাকা ধীরে ধীরে একটি সামাজিক সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত হতে শুরু করে। যৌনকর্মীদের প্রতি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি নেতিবাচক ছিল, এবং তাদের স্বাস্থ্যের সমস্যাগুলি ও অর্থনৈতিক দারিদ্র্যের কারণে তাঁরা অনেক চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হন।

২১শ শতক

বর্তমানে, সোনাগাছি কলকাতার সবচেয়ে বড় লাল বাতির এলাকা হিসেবে পরিচিত। এখানে আনুমানিক ১০,০০০ যৌনকর্মী রয়েছেন। নারীরা অধিকাংশ সময় দরিদ্রতাজনিত কারণে এবং পরিবারের অশান্তির জন্য এই পেশায় প্রবেশ করেন। তারা শোষণ ও অমানবিক অবস্থার মধ্যে বাস করেন, এবং অনেক সময় নিজেদের সুরক্ষার জন্য লড়াই করতে হয়।

জনসংখ্যা ও পেশা

সোনাগাছির যৌনকর্মীদের মধ্যে বেশিরভাগই ১৮ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে। অনেকে পরিবারের অস্বচ্ছলতা এবং কর্মসংস্থানের অভাবে এই পেশায় ঢোকেন। একটি সমীক্ষা অনুযায়ী, সোনাগাছির ৮০% যৌনকর্মী কোনো প্রকারের আনুষ্ঠানিক শিক্ষা লাভ করেননি। 

সোনাগাছির যৌনকর্মীদের বেশিরভাগই পশ্চিমবঙ্গের গ্রামাঞ্চল ও দরিদ্র অঞ্চল থেকে আসেন। বিশেষত, উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগণা, মুর্শিদাবাদ, মালদহ, এবং বিহার ও ওড়িশার কিছু অঞ্চলের দরিদ্র পরিবার থেকে নারীরা অর্থনৈতিক সমস্যার কারণে এই পেশায় প্রবেশ করেন। তাদের মধ্যে অনেকে মানব পাচারের শিকার হয়ে এখানে আসতে বাধ্য হন, এবং দালালদের মাধ্যমে তাদেরকে বিভিন্ন ব্রোথেলে নিয়ে আসা হয়।

সোনাগাছির যৌনকর্মীদের গ্রাহক সাধারণত বিভিন্ন সামাজিক স্তরের মানুষ, যার মধ্যে স্থানীয় ব্যবসায়ী, পেশাজীবী, মাঝারি আয়ের কর্মজীবী পুরুষ এবং পর্যটকরা অন্তর্ভুক্ত। এছাড়া, অনেক সময় বিভিন্ন পেশাজীবী পুরুষ এবং অভিজাত শ্রেণির কিছু মানুষও এখানে আসেন। এই গ্রাহকগোষ্ঠীর মধ্যে বয়সের তারতম্য দেখা যায়, যা সাধারণত ২০ থেকে ৫০ বছরের মধ্যে থাকে।

আয় ও অর্থনৈতিক অবস্থা

সোনাগাছির যৌনকর্মীরা প্রতিদিন গড়ে ৩০০ থেকে ১,০০০ রুপি (প্রায় ৩৬০ থেকে ১,২০০ টাকা) উপার্জন করেন। এটি তাদের দৈনন্দিন খরচের জন্য যথেষ্ট নয়। এছাড়া, এখানে নারীরা অনেক সময় দালাল বা ব্রোথেল মালিকদের দ্বারা শোষিত হন, যারা তাদের আয়ের একটি বড় অংশ কেটে নেন।

সোনাগাছির মতো অঞ্চলে ঘর ভাড়ার পরিমাণ নির্ভর করে বিভিন্ন বিষয়ের ওপর, যেমন ঘরের অবস্থান, আকার, এবং অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা। সাধারণত সোনাগাছিতে ছোট ব্রোথেলে একটি ঘর দৈনিক বা ঘণ্টাভিত্তিক ভাড়ায় পাওয়া যায়।

এখানে ঘণ্টাভিত্তিক ভাড়ার হার সাধারণত ২০০ থেকে ৫০০ রুপি (বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ২৪০ থেকে ৬০০ টাকা) হয়ে থাকে, তবে নির্দিষ্ট ব্রোথেল ও দালালের ওপর এই হার বেশি হতে পারে। দৈনিক বা দীর্ঘমেয়াদী ভাড়ার ক্ষেত্রে, সাধারণত ১৫০০ থেকে ৩০০০ রুপি (বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ১৮০০ থেকে ৩৬০০ টাকা) পর্যন্ত হতে পারে।


দালাল চক্র ও শোষণ

সোনাগাছিতে দালাল চক্রের কার্যক্রম ব্যাপক, যেখানে অনেক নারী ভাড়া করেন। এখানে ব্রোথেল মালিকরা এবং দালালরা ঘর ভাড়ার বিষয়ে নিয়ন্ত্রণ রাখে এবং অনেক সময় শর্ত সাপেক্ষে বেশি ভাড়া নেয়, যা যৌনকর্মীদের অর্থনৈতিক শোষণের একটি অংশ।

এই দালালরা তাদের নিয়ন্ত্রণে রাখে এবং আয় থেকে এক বড় অংশ নিয়েই নেয়। এছাড়া, যৌনকর্মীরা পুলিশের হস্তক্ষেপ এবং সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির শিকার হন। এই অঞ্চলের যৌনকর্মীরা নিজেদের নিরাপত্তা এবং স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য অনেক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হন।

সামাজিক সমস্যা ও পুনর্বাসন

সোনাগাছির যৌনকর্মীরা সামাজিক শৃঙ্খলার নিম্নমানের কারণে নানা সমস্যার সম্মুখীন হন। অনেকে পরিচ্ছন্নতা ও স্বাস্থ্য সুরক্ষা বিষয়ে সচেতন নয়, যার ফলে তারা নানা রোগের শিকার হন। সুতরাং, এখানে শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য সচেতনতা বাড়ানোর প্রয়োজন রয়েছে। এনজিও এবং সরকারী সংস্থাগুলি যৌনকর্মীদের জন্য পুনর্বাসন এবং বিকল্প পেশায় প্রবেশের সুযোগ সৃষ্টি করতে কাজ করছে।

উপসংহার

সোনাগাছি একটি জটিল সমাজ এবং অর্থনৈতিক কাঠামোর প্রতিনিধিত্ব করে, যেখানে নারীরা নানা ধরনের চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছেন। এই এলাকায় যৌনকর্মীদের জন্য সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধির পাশাপাশি স্বাস্থ্যসেবা এবং পুনর্বাসনের সুযোগ তৈরি করা জরুরি।
আপনি যদি সোনাগাছি সম্পর্কে আরও বিস্তারিত জানতে চান বা বিশেষ কোনো দিক নিয়ে আলোচনা করতে চান, তাহলে জানাবেন!

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ