ডলারের আধিপত্যের পেছনে গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের ভূমিকা: ব্রেটন উডস চুক্তি থেকে পেট্রোডলারের উত্থান।
১. ব্রেটন উডস চুক্তি (১৯৪৪): যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পুনর্গঠন
ব্রেটন উডস চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল ১৯৪৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ফ্র্যাঙ্কলিন ডি. রুজভেল্টের নেতৃত্বে। এই চুক্তি গঠনে মার্কিন অর্থমন্ত্রী হেনরি মরগেনথাউ এবং ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ জন মেনার্ড কেইনস গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। এই চুক্তি মার্কিন ডলারকে গোল্ড স্ট্যান্ডার্ডের সঙ্গে যুক্ত করে এবং ডলারকে কেন্দ্রীয় রিজার্ভ মুদ্রা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে। জন মেনার্ড কেইনস এই মুদ্রা ব্যবস্থার মাধ্যমে স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে চেয়েছিলেন, যা যুদ্ধ-পরবর্তী পুনর্গঠনকে সহজ করে তোলে।
২. নিক্সন শক (১৯৭১): সোনার মান ত্যাগের সিদ্ধান্তে রিচার্ড নিক্সন ও তার উপদেষ্টা দল
১৯৭১ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন ডলারের সোনার মান থেকে বিচ্ছিন্ন করার ঘোষণা দেন। এ সিদ্ধান্তে তার অর্থনৈতিক উপদেষ্টা মিল্টন ফ্রিডম্যান, আর্থার বার্নস (তৎকালীন ফেডারেল রিজার্ভ চেয়ারম্যান), এবং ট্রেজারি সেক্রেটারি জন কন্যালির মতো বিশিষ্ট ব্যক্তিরা তার পাশে ছিলেন। মিল্টন ফ্রিডম্যান মূলত এই ধারণার প্রবক্তা ছিলেন যে, মুদ্রার মান বাজারের চাহিদা ও সরবরাহের ওপর নির্ভর করা উচিত। এই ঘোষণা ছিল অর্থনীতিতে একটি বড় ধরনের পরিবর্তন, যা পরবর্তী সময়ে আন্তর্জাতিক বাজারে ডলারের ওপর নির্ভরশীলতা আরও বাড়ায়।
৩. পেট্রোডলারের উদ্ভব (১৯৭০-এর দশক): হেনরি কিসিঞ্জারের মধ্যস্থতায় চুক্তি
১৯৭০-এর দশকে পেট্রোডলারের ধারণা প্রতিষ্ঠায় মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জারের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সৌদি আরব এবং OPEC-এর সঙ্গে একটি সমঝোতা চুক্তি করা হয়, যার অধীনে সব তেল লেনদেন ডলারে নির্ধারিত হয়। সৌদি আরবের রাজা ফয়সাল এবং মার্কিন সরকারের আলোচনার ফলে এই চুক্তি কার্যকর হয়। কিসিঞ্জারের এই উদ্যোগ ডলারের স্থিতি আরও শক্তিশালী করে তোলে, এবং বিশ্ব বাণিজ্যে একে অপরিহার্য মুদ্রা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে।
৪. আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান ও ডলার: আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা সদস্যরা
ডলারের আধিপত্যকে নিশ্চিত করার পেছনে আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। ব্রেটন উডস চুক্তির সময়ে গঠিত এই প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রথম পরিচালক ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের হ্যারি ডেক্সটার হোয়াইট (আইএমএফ) এবং জন জে ম্যাকক্লয় (বিশ্বব্যাংক)। তাদের নেতৃত্বে এই প্রতিষ্ঠানগুলো ডলারে ঋণ প্রদান শুরু করে, যা বৈশ্বিক আর্থিক ব্যবস্থায় মার্কিন ডলারের প্রভাব আরও বিস্তৃত করে। উন্নয়নশীল দেশগুলোও ঋণের মাধ্যমে ডলারের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে, যা মার্কিন অর্থনীতির সাথে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক সম্পর্ককে আরও মজবুত করে তোলে।
৫. বিকল্প প্রচেষ্টা ও চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি ডলার: চীন, রাশিয়া, ও ভারতের নেতৃবৃন্দের প্রচেষ্টা
২০০৮ সালের অর্থনৈতিক সংকটের পর ডলারের আধিপত্য চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে, এবং বিভিন্ন দেশ নিজস্ব মুদ্রার ব্যবহারকে উৎসাহিত করার চেষ্টা করে। চীনের প্রেসিডেন্ট হু জিনতাও, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন, এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং এই উদ্যোগে নেতৃত্ব দেন। তারা চীনা ইউয়ান এবং রাশিয়ান রুবলকে আন্তর্জাতিক মুদ্রা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছেন এবং নিজেদের মধ্যে বাণিজ্যে ডলারের পরিবর্তে নিজস্ব মুদ্রা ব্যবহারের পরিকল্পনা নেন।
উপসংহার:
ডলারের এই রাজত্বে বিশ্ব অর্থনীতির স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে অনেক নেতা, অর্থনীতিবিদ এবং মুদ্রা বিশেষজ্ঞ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। ডলারের প্রভাব বিশ্বের বিভিন্ন দেশের অর্থনৈতিক সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করে আসছে, যা বৈশ্বিক অর্থনীতির জন্য একটি শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করেছে।
0 মন্তব্যসমূহ