তাবলীগ জামাতের প্রতিষ্ঠা
তাবলীগ জামাতের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন মাওলানা মুহাম্মাদ ইলিয়াস কান্ধলভী (১৮৮৫–১৯৪৪), যিনি ভারতের মেওয়াত অঞ্চলের মানুষের ধর্মীয় অবস্থার প্রতি চিন্তিত ছিলেন। মেওয়াতের মুসলমানদের জীবনে ধর্মীয় জ্ঞান ও চেতনার অভাব লক্ষ্য করে তিনি তাদের ইসলামী শিক্ষা ও আচার অনুসরণে উদ্বুদ্ধ করতে চেয়েছিলেন। মাওলানা ইলিয়াসের মূল লক্ষ্য ছিল সাধারণ মুসলমানদের ইসলামের বুনিয়াদি শিক্ষা প্রদান করা, যাতে তারা তাদের দৈনন্দিন জীবনে ইসলামিক নীতি-আদর্শ অনুসরণ করতে পারে। তাঁর বিখ্যাত শ্লোগান ছিল, “আও মুসলমান বনাও” (এসো, প্রকৃত মুসলমান হও)। এই আহ্বানের মাধ্যমেই তাবলীগ জামাতের প্রাথমিক কাঠামো গড়ে ওঠে।
তাবলীগ জামাতের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য
তাবলীগ জামাতের মূল লক্ষ্য হলো মুসলমানদের ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে ইসলামী চেতনাকে সুপ্রতিষ্ঠিত করা। এই সংগঠনের মাধ্যমে মুসলমানদের পাঁচটি মূল বিষয় শেখানো হয়:
১. ঈমানের মজবুত ভিত্তি গড়ে তোলা। ২. নামাজের গুরুত্ব ও তাৎপর্য বোঝানো এবং নিয়মিত নামাজ পড়ার অভ্যাস তৈরি করা। ৩. ইসলামী জ্ঞান অর্জনের গুরুত্ব এবং এর প্রচারের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরা। ৪. ইখলাস (নিষ্ঠা) ও ইহসানের মাধ্যমে আত্মশুদ্ধি অর্জন করা। ৫. ইসলামী সমাজ গঠন এবং সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ প্রসার।
তাবলীগ জামাতের কাজের ধরন মোটেও প্রথাগত শিক্ষা পদ্ধতির মতো নয়; বরং এর সদস্যরা একাধিক দলে ভাগ হয়ে বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে এবং ব্যক্তিগত উদাহরণের মাধ্যমে ইসলামের দাওয়াত প্রচার করেন।
তাবলীগ জামাতের বিশেষ পদ্ধতি: গাশত ও চিল্লা
তাবলীগ জামাতের দাওয়াত কার্যক্রমে একটি বিশেষ পদ্ধতি রয়েছে যা গাশত নামে পরিচিত। গাশত হলো ছোট দল গঠন করে এলাকায় এলাকায় গিয়ে মুসলমানদের মাঝে ইসলামী শিক্ষা ছড়িয়ে দেওয়া। সাধারণত মসজিদ থেকে শুরু করে আশেপাশের বাড়ি-বাড়ি গিয়ে মানুষের সাথে কথা বলে তাদেরকে দাওয়াত দেওয়া হয়।
তাবলীগ জামাতের সদস্যরা বিভিন্ন মেয়াদে সময় ব্যয় করেন, যেমন ৩ দিন, ১০ দিন, ৪০ দিন (চিল্লা) এবং ৪ মাস। বিশেষ করে চিল্লা হলো ৪০ দিনের একটি সময়কাল, যা একজন তাবলীগ জামাতের সদস্যের জন্য প্রশিক্ষণমূলক এবং আত্মশুদ্ধির গুরুত্বপূর্ণ সময় হিসেবে বিবেচিত হয়। এই সময়ে তারা ধর্মীয় জ্ঞান অর্জন করেন এবং ব্যক্তিগত আচরণের সংশোধন ও উন্নয়নে মনোনিবেশ করেন।
তাবলীগ জামাতের প্রচারকৃত মূল নীতি ও কাজের পরিসর
তাবলীগ জামাতের নীতি ও কাজের পরিসর বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সরাসরি নবী মুহাম্মদ (সাঃ)-এর জীবনের দৃষ্টান্তের উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে। দলটির প্রতিষ্ঠাতারা মনে করেন, ইসলামের প্রকৃত শিক্ষা শুধুমাত্র ব্যক্তিগত অনুশীলনের মাধ্যমেই উপলব্ধি করা সম্ভব। তাই তারা একে অপরের সহচর্য্যে ধর্মীয় কাজ করে নিজেদের উন্নত ও পরিশুদ্ধ করার চেষ্টা করেন।
তাবলীগ জামাতের কাজের ধরন একদিকে যেমন সহজ ও বিনয়পূর্ণ, তেমনি এটি মুসলমানদের একে অপরের সাথে আধ্যাত্মিক বন্ধনও স্থাপন করে। এটি ধনী-গরিব, শিক্ষিত-অশিক্ষিত সকল মুসলমানদের মধ্যে ধর্মীয় চেতনা এবং নৈতিক উন্নতির জন্য একটি সমান সুযোগ তৈরি করে।
তাবলীগ জামাতের আন্তর্জাতিক বিস্তার
তাবলীগ জামাতের দাওয়াত কার্যক্রম প্রথমে ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলমানদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল, কিন্তু পরে তা বিশ্বের অন্যান্য দেশেও বিস্তৃত হয়। ১৯৪৪ সালে মাওলানা ইলিয়াসের মৃত্যুর পর তার উত্তরসূরিরা তার দাওয়াতের কাজ চালিয়ে যান এবং বিভিন্ন দেশে দাওয়াতি কার্যক্রম পরিচালনা করেন। বর্তমানে তাবলীগ জামাত বিশ্বের প্রায় সবকটি দেশে সক্রিয় এবং তাদের বার্ষিক সভা (ইজতেমা) অনুষ্ঠিত হয় যা লাখ লাখ মুসলিমকে একত্রিত করে। বাংলাদেশের টঙ্গীর তুরাগ নদীর তীরে অনুষ্ঠিত বিশ্ব ইজতেমা এদের মধ্যে সবচেয়ে বৃহৎ এবং এটি একটি বিশেষ গুরুত্বের অধিকারী।
তাবলীগ জামাতের চ্যালেঞ্জ ও সমালোচনা
তাবলীগ জামাতের উপর বিভিন্ন সময়ে সমালোচনাও উঠেছে। তাদের রাজনীতি থেকে দূরে থাকার অবস্থান এবং শুধুমাত্র ব্যক্তিগত উন্নতির উপর গুরুত্ব দেওয়ার নীতি নিয়ে কিছু ধর্মীয় ও রাজনৈতিক গোষ্ঠী সমালোচনা করেছে। তারা মনে করেন, তাবলীগ জামাত সামাজিক ও রাজনৈতিক সমস্যাগুলো থেকে দূরে থেকে কেবল ব্যক্তিগত পরিবর্তনের উপর জোর দেয়, যা সমাজের বৃহত্তর সমস্যাগুলি সমাধানে সহায়ক নয়।
অন্যদিকে, সাম্প্রতিক সময়ে তাবলীগ জামাতের ভেতরে নেতৃত্ব সংক্রান্ত বিতর্কও দেখা গেছে, বিশেষ করে মাওলানা সাদ কান্ধলভীর নেতৃত্বকে ঘিরে মতবিরোধ সৃষ্টি হয়েছে। এই মতবিরোধের কারণে তাবলীগ জামাতের বিভিন্ন শাখায় বিভক্তি দেখা দিয়েছে যা এর ঐক্যের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।
উপসংহার
তাবলীগ জামাতের ইতিহাস ও কার্যক্রম ইসলামী জগতের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলনগুলোর একটি অধ্যায়। এর মূল লক্ষ্য ইসলামের মৌলিক শিক্ষা ও মূল্যবোধ ব্যক্তিগত এবং সামাজিক জীবনে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করা। যদিও বর্তমান সময়ে তাবলীগ জামাত কিছু চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছে, তবুও এটি আজও বিশ্বের কোটি কোটি মুসলমানের ধর্মীয় চেতনা ও ব্যক্তিগত উন্নয়নের একটি প্রধান অবলম্বন হিসেবে টিকে আছে।
তাবলীগ জামাতের ইতিহাসকে পর্যালোচনা করে বলা যায়, এর প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা ইলিয়াসের চিন্তাভাবনা ও দৃষ্টিভঙ্গি মুসলিম সমাজের জন্য গভীর প্রভাব বিস্তার করেছে, যা বহু বছর ধরে ধর্মীয় অনুশীলন ও শিক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে।
0 মন্তব্যসমূহ