ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি ১৯৮৯ সাল থেকে দেশটির রাজনৈতিক ও ধর্মীয় নেতৃত্বে রয়েছেন। দীর্ঘ ত্রিশ বছরেরও বেশি সময় ধরে তিনি ইরানকে নেতৃত্ব দিয়ে চলেছেন, যার মাধ্যমে দেশটি আঞ্চলিক এবং বৈশ্বিক অঙ্গনে প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছে। তার নেতৃত্বে ইরান সামরিক, অর্থনৈতিক, ও ধর্মীয় দিক থেকে শক্তিশালী একটি রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে উঠেছে। বর্তমানে দেশটি আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা, পারমাণবিক কর্মসূচির চাপ, এবং অভ্যন্তরীণ বিক্ষোভসহ নানা চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হলেও, খামেনির কঠোর অবস্থান ইরানের স্বতন্ত্র অবস্থান বজায় রেখেছে।
খামেনির জীবনী ও শৈশব
১৯৩৯ সালের ১৭ জুলাই মাশহাদ শহরে জন্মগ্রহণ করা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির শৈশব কাটে একটি ধর্মপ্রাণ পরিবারে। তার পিতা আয়াতুল্লাহ সাইয়েদ জাওয়াদ খামেনি একজন সম্মানিত আলেম ছিলেন। ধর্মীয় শিক্ষা নিয়ে বেড়ে ওঠা খামেনি কুরআন, হাদিস, এবং ইসলামী ফিকহের গভীর জ্ঞান অর্জন করেন। পরবর্তী সময়ে তিনি ক্বুম শহরে চলে যান এবং সেখানে ইসলামি শাস্ত্রে উচ্চতর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। তার শিক্ষকদের মধ্যে অনেক প্রভাবশালী আলেম ছিলেন যারা তার জীবন ও চিন্তাধারাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেন।
রাজনৈতিক জীবনে উত্থান
খামেনি রাজনীতিতে প্রবেশ করেন ইরানের শাহ শাসনব্যবস্থার বিরুদ্ধে বিপ্লবী মনোভাব নিয়ে। ১৯৭৯ সালের ইসলামি বিপ্লবের পর তিনি খোমেনির নেতৃত্বে শাহ শাসনের পতন এবং একটি ইসলামিক প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখেন। বিপ্লব-পরবর্তী সময়ে তিনি ইরানের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন এবং পরবর্তীতে ১৯৮৯ সালে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা হিসেবে নির্বাচিত হন।
খামেনির নেতৃত্বে ইরানের সামরিক ও প্রতিরক্ষা শক্তি বৃদ্ধি
ইরানের সামরিক শক্তি বৃদ্ধিতে খামেনির নেতৃত্বে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। তার নির্দেশনায় ইরান নিজস্ব সামরিক গবেষণা ও উন্নয়নে মনোযোগ দিয়ে স্বনির্ভর সামরিক শক্তি গড়ে তুলেছে। বর্তমানে ইরানের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা আধুনিক ক্ষেপণাস্ত্র, ড্রোন এবং বিভিন্ন সামরিক প্রযুক্তির মাধ্যমে শক্তিশালী হয়েছে, যা ইরানের আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিক সুরক্ষার জন্য অপরিহার্য বলে মনে করা হচ্ছে।
পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে আন্তর্জাতিক বিতর্ক
খামেনির নির্দেশনায় ইরান তার পারমাণবিক কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছে, যা দেশের জাতীয় নিরাপত্তা এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত। ইরান তার পরমাণু কর্মসূচিকে বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং অন্যান্য শান্তিপূর্ণ কাজে ব্যবহারের কথা বললেও, পশ্চিমা দেশগুলো এই কর্মসূচি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করছে। বর্তমান সময়ে এই কর্মসূচি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ইরানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য পশ্চিমা দেশের মধ্যে উত্তেজনার একটি বড় কারণ হিসেবে রয়ে গেছে।
অভ্যন্তরীণ বিক্ষোভ ও সামাজিক চ্যালেঞ্জ
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ইরানে বিভিন্ন ধরনের সামাজিক এবং অর্থনৈতিক সমস্যার কারণে জনবিক্ষোভ দেখা দিয়েছে। অর্থনৈতিক সংকট, কর্মসংস্থানের অভাব, এবং নারীদের অধিকারের প্রশ্নে জনগণের মধ্যে অসন্তোষ বৃদ্ধি পেয়েছে। আয়াতুল্লাহ খামেনি এসব বিক্ষোভকে বিদেশি শক্তির প্ররোচনা বলে মনে করছেন এবং দেশের নিরাপত্তা রক্ষায় কঠোর পদক্ষেপ নিচ্ছেন। তার মতে, এসব বিক্ষোভ দেশের স্থিতিশীলতা নষ্ট করার একটি ষড়যন্ত্র।
প্রতিরোধী অর্থনীতি মডেল ও অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলা
খামেনি ইরানের অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলায় ‘প্রতিরোধী অর্থনীতি’র ধারণা নিয়ে এসেছেন। আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার প্রভাব কমাতে দেশীয় উৎপাদন বাড়ানো, কৃষি ও শিল্প খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধি, এবং আত্মনির্ভর অর্থনীতি গড়ে তোলার লক্ষ্যে এই মডেল চালু করা হয়। ইরানে বর্তমানে খাদ্য, ওষুধ এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় পণ্য উৎপাদনে বিশেষ মনোযোগ দেয়া হচ্ছে যাতে আন্তর্জাতিক নির্ভরতা কমিয়ে আনা যায়।
মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের প্রভাব বিস্তার
খামেনির নেতৃত্বে ইরান মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক মজবুত করে একটি শক্তিশালী আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছে। সিরিয়া, ইরাক এবং লেবাননের মতো দেশে ইসলামি গোষ্ঠীগুলোর সমর্থনে ইরানের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে বাশার আল আসাদ সরকারের প্রতি সমর্থন এবং ইয়েমেনে হুতি বিদ্রোহীদের সহযোগিতা প্রদানের মাধ্যমে ইরান মধ্যপ্রাচ্যে তার প্রভাব বিস্তার করেছে। তবে, এসব পদক্ষেপ ইরানের জন্য যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে।
উপসংহার
আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির নেতৃত্বে ইরান তার স্বাধীনতা, সংস্কৃতি এবং ধর্মীয় আদর্শের ওপর ভিত্তি করে একটি স্বতন্ত্র অবস্থানে রয়ে গেছে। ইরান তার সামরিক শক্তি, অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং ধর্মীয় মূল্যবোধ বজায় রেখে চলার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক চাপ মোকাবিলায়ও সচেষ্ট। অভ্যন্তরীণ বিক্ষোভ, নিষেধাজ্ঞা, এবং আন্তর্জাতিক চাপের মুখে দাঁড়িয়েও খামেনি তার নীতি থেকে সরে আসছেন না। তার কঠোর অবস্থান ইরানকে বর্তমান বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে একটি শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সহায়ক হয়েছে।
0 মন্তব্যসমূহ