BRICS এবং মুদ্রা ব্যবস্থা: ভূমিকা ও প্রভাব


BRICS হলো একটি আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক জোট, যেখানে পাঁচটি উদীয়মান অর্থনীতির দেশ – ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন এবং দক্ষিণ আফ্রিকা অন্তর্ভুক্ত। এই জোটের মূল উদ্দেশ্য হলো সদস্য দেশগুলোর মধ্যে অর্থনৈতিক সহযোগিতা বাড়ানো এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে মার্কিন ডলারের একচ্ছত্র প্রভাব কমানো। ২০০১ সালে প্রথমবারের মতো এই ধারণাটি উদ্ভব হয় "BRIC" নামে, যা ২০১০ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার অন্তর্ভুক্তির পর BRICS নামে পরিচিতি পায়।

BRICS দেশগুলো বর্তমানে ডলারের উপর নির্ভরশীল, যা তাদের অর্থনীতিকে নানা সময়ে হুমকির মুখে ফেলে। এজন্য তারা একটি বিকল্প মুদ্রা ব্যবস্থার উদ্যোগ নিচ্ছে, যাতে সদস্য দেশগুলো নিজেদের মধ্যে সরাসরি লেনদেন করতে পারে এবং আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক মঞ্চে শক্তিশালী ভূমিকা পালন করতে পারে। বাংলাদেশের মতো উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলোর জন্য এই মুদ্রা ব্যবস্থা কিছু সম্ভাবনা ও ঝুঁকি নিয়ে আসতে পারে।

BRICS-এর মুদ্রা ব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তা এবং উদ্যোগ

BRICS দেশগুলো একক মুদ্রার মাধ্যমে একটি বিকল্প মুদ্রা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে চায়। তাদের উদ্দেশ্য হলো, ডলারের উপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে আনা এবং সদস্য দেশগুলোর অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা রক্ষা করা। BRICS-এর জন্য এটি একটি বড় পদক্ষেপ হবে, কারণ একক মুদ্রার মাধ্যমে তাদের অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য ও বিনিয়োগের ক্ষেত্রে স্বাধীনতা থাকবে।

একক মুদ্রা ব্যবস্থার চ্যালেঞ্জ

তবে BRICS-এর মধ্যে একটি একক মুদ্রা চালু করার ক্ষেত্রে কিছু বড় চ্যালেঞ্জ রয়েছে:

1. মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বাধা: BRICS দেশগুলোতে ভিন্ন ভিন্ন অর্থনৈতিক অবস্থা ও মুদ্রাস্ফীতি রয়েছে। তাই, একটি একক মুদ্রা ব্যবস্থায় সকল সদস্য দেশের জন্য একই ধরনের আর্থিক নীতি কার্যকর করা কঠিন।

2. রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা: চীন এবং রাশিয়া নিজেদের আর্থিক ও রাজনৈতিক শক্তি ধরে রাখতে চায়। ফলে তারা একক মুদ্রার উপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারে, যা অন্য দেশগুলোর জন্য সমস্যার কারণ হতে পারে।

3. পরিকাঠামো ও প্রযুক্তিগত প্রতিবন্ধকতা: একক মুদ্রা চালু করতে হলে একটি কেন্দ্রীয় ব্যাংকিং ব্যবস্থা গঠন করতে হবে এবং সদস্য দেশগুলোকে পরিকাঠামোগত উন্নয়ন ও প্রযুক্তিগত সমন্বয় করতে হবে।

BRICS New Development Bank (NDB)

BRICS-এর নিজস্ব উন্নয়ন ব্যাংক New Development Bank (NDB), যা মূলত সদস্য দেশগুলোর মধ্যে অর্থনৈতিক সহযোগিতা বাড়ানোর লক্ষ্যে কাজ করে। এটি বিভিন্ন উন্নয়নমূলক প্রকল্পে অর্থায়ন করে এবং এর লক্ষ্য হলো বিশ্বব্যাংক ও IMF-এর বিকল্প ব্যবস্থা গড়ে তোলা, যেখানে ডলারের পরিবর্তে সদস্য দেশগুলোর মুদ্রায় লেনদেন করা যায়। NDB-এর মাধ্যমে বাংলাদেশও আর্থিক সহায়তা এবং ঋণের সুবিধা পেতে পারে, যা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে সহায়ক হতে পারে।

বাংলাদেশের জন্য BRICS মুদ্রা ব্যবস্থার সুবিধা

1. ডলারের উপর নির্ভরশীলতা কমানো: BRICS মুদ্রা ব্যবস্থায় যুক্ত হলে বাংলাদেশ তার আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে ডলারের পরিবর্তে BRICS-এর মুদ্রা ব্যবহার করতে পারে, যা বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভকে শক্তিশালী করবে এবং আর্থিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে সহায়ক হবে।

2. সাশ্রয়ী বিনিয়োগ ও ঋণ গ্রহণের সুযোগ: NDB-এর মাধ্যমে বাংলাদেশ তুলনামূলক সহজ শর্তে ঋণ এবং বিনিয়োগ সুবিধা পেতে পারে। এতে দেশের অবকাঠামো এবং অর্থনৈতিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে।

3. বাণিজ্যের সম্প্রসারণ: BRICS-এর মুদ্রা ব্যবস্থায় যুক্ত হলে ভারত ও চীনের মতো বড় অর্থনীতির দেশগুলোর সাথে বাংলাদেশের বাণিজ্যিক খরচ কমে যেতে পারে এবং এটি দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে আরও শক্তিশালী করবে।

4. আন্তর্জাতিক মুদ্রা ব্যবস্থায় অংশগ্রহণের সুযোগ: BRICS-এর মুদ্রা ব্যবস্থা বৈশ্বিক অর্থনীতিতে একটি নতুন সংযোজন হতে পারে। এটি বাংলাদেশের মতো দেশগুলোকে আরও কার্যকরভাবে অংশগ্রহণের সুযোগ দেবে এবং আন্তর্জাতিক মুদ্রা বিনিময় বাজারে প্রবেশাধিকার বাড়াবে।

বাংলাদেশের জন্য BRICS মুদ্রা ব্যবস্থার অসুবিধা

1. মুদ্রা বিনিময় হারের ঝুঁকি: একক মুদ্রা ব্যবস্থার কারণে বাংলাদেশকে মুদ্রা বিনিময় হারের অনিশ্চয়তা মোকাবিলা করতে হতে পারে, যা দেশের মুদ্রাস্ফীতির উপর বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে।

2. রাজনৈতিক জটিলতা: BRICS মুদ্রা ব্যবস্থায় যুক্ত হওয়ার ফলে বাংলাদেশের জন্য আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক অবস্থানে পরিবর্তন আসতে পারে। বিশেষ করে পশ্চিমা মিত্র রাষ্ট্রগুলো, যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন, এ সিদ্ধান্তকে ভালোভাবে নাও নিতে পারে, যা বাংলাদেশের কূটনৈতিক অবস্থানে প্রভাব ফেলতে পারে।

3. বাণিজ্য বৈচিত্র্যের সংকট: BRICS দেশগুলোর সাথে বেশি বাণিজ্য করতে হলে বাংলাদেশ তার প্রচলিত বাণিজ্য সহযোগীদের সাথে সম্পর্ক হ্রাস করতে পারে, যা বৈচিত্র্যময় বাজারে সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে।

4. বিশ্ব মুদ্রা বাজারের অস্থিরতা: BRICS মুদ্রা ব্যবস্থার ফলে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে মুদ্রার প্রতিযোগিতা ও অস্থিরতা সৃষ্টি হতে পারে। এর ফলে বাংলাদেশের মতো উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলোতে বৈদেশিক মুদ্রার চাপ বাড়তে পারে এবং অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।

উপসংহার

BRICS-এর মুদ্রা ব্যবস্থায় বাংলাদেশ যুক্ত হলে কিছু উল্লেখযোগ্য সুবিধা পেতে পারে, যেমন ডলারের উপর নির্ভরশীলতা কমানো, সাশ্রয়ী ঋণ গ্রহণ এবং ভারতের মতো দেশের সাথে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য বৃদ্ধির সুযোগ। তবে এর সাথে কিছু চ্যালেঞ্জও রয়েছে, বিশেষ করে মুদ্রা বিনিময়ের ঝুঁকি এবং আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক সম্পর্কের জটিলতা। বাংলাদেশের জন্য এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা, বাণিজ্যিক স্বার্থ এবং কূটনৈতিক দিকগুলোকে বিবেচনায় রেখে সাবধানতা অবলম্বন করা গুরুত্বপূর্ণ।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ