বিশ্বব্যাপী দোদুল্যমান সোনার বাজার। এই বাড়ছে তো এই কমছে। বিশ্ববাজারের এ প্রভাব পড়ছে দেশেও। বিশ্ববাজারে সোনার দাম প্রথমবারের মতো প্রতি আউন্স ২ হাজার ৬০০ ডলার ছাড়িয়েছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে দেশেও দেড় লাখ টাকা ছুঁই ছুঁই করছে সোনার ভরি। সোনার দামের ওঠা-নামায় কেউ লাভবান হচ্ছেন, আবার কেউ বইছেন লোকসানের বোঝা।
সোনার এই লাফঝাঁপে লাভ-ক্ষতির হিসাব মিলিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। তাদের মতে, সোনার দাম বাড়লে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মুখে পড়েন মহাজনরা। তারা সবসময় পুরাতন সোনা কিনে সেগুলোতে কিছুটা কারুকাজ করে আবার বিক্রি করেন। অনেক সময় দেখা যায়- মহাজনরা সোনা কেনার পর কারুকাজ শেষে বিক্রির আগেই দাম কমে যায়। এ সময় তাদের লোকসান পুরোটাই গুনতে হয়। আবার দাম বাড়লে কিছুটা লোকসান গুনতে হয় ব্যবসায়ীদেরও। তবে সেই লোকসান কাটিয়ে উঠতে বেশি সময় নেন না তারা।
যেসব কারণে বাড়ে-কমে সোনার দাম
সোনার দাম ওঠা-নামার কারণ হিসেবে দায়ী করা হচ্ছে করোনা মহামারি, চলমান ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ ও বিশ্বব্যাপী ডলার সংকটকে। এ বিষয়ে বিশেষঙ্গরা বলছেন-
মানুষ যখনই ডলারের ওপর আস্থা হারায়, তখনই সোনার দিকে ঝুঁকে পড়ে। কাছাকাছি সময়ে যতগুলো যুদ্ধ হয়েছে (ইরান, ইরাক, লিবিয়া), এর পরই সোনার দাম বেড়েছে। এমনকি চীন-আমেরিকার অর্থনৈতিক যুদ্ধের প্রভাবও পড়েছে সোনার আন্তর্জাতিক বাজারে।
সোনার দাম ওঠা-নামার কারণ হিসেবে দায়ী করা হচ্ছে করোনা মহামারি, চলমান ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ ও বিশ্বব্যাপী ডলার সংকটকে।
বিশেষঙ্গরা বলছেন, বর্তমানে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের প্রভাবও সোনার বাজারে পড়েছে। ইউরোপের মানুষও এখন সোনার দিকে ঝুঁকছে। এটাও বিশ্বব্যাপী সোনার দাম বাড়ার অন্যতম কারণ। মোদ্দা কথা হলো- আন্তর্জাতিক বাজারে ডলারের দাম কমে যাওয়ার প্রভাব পড়ে স্বর্ণের বাজারে। বিভিন্ন দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকে ডলার যেমন থাকে, তেমনি সোনাও গচ্ছিত থাকে। ব্যাংকগুলো সংকটের সময় সোনা বেশি কেনে, তখনো এর দাম বেড়ে যায়।
ক্রুড অয়েল বা অপরিশোধিত তেল এবং সোনা একে অপরের সঙ্গে জড়িত। তেলের দাম বাড়লেও সোনার দাম বাড়ে। কারণ প্রায়ই অপরিশোধিত তেলের দাম পরিশোধ করা হয় সোনা দিয়ে। দেশ-বিদেশে সোনার দাম বাড়া-কমার পেছনে এটাও বড় একটা কারণ।
সোনা যখন বিনিয়োগ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক সায়মা হক বলেন, আমাদের দেশে অনেক পরিবারে সোনা জমিয়ে রাখার প্রবণতা রয়েছে। এটি এমন একটি বিনিয়োগ, যা কিনলে, জমিয়ে রাখলে বা বিক্রি করলে ক্ষতির আশঙ্কা থাকে না। তবে টানা দরপতনে বড় ধরনের ক্ষতি হতে পারে।
উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, করোনা মহামারির সময় অনেক ব্যবসায় ধস নেমেছিল, তখন বিনিয়োগে এক ধরনের অনিশ্চয়তা ছিল। যখন কোনো বিপর্যয় বা অনিশ্চয়তা তৈরি হয়, একটি অর্থনীতি দুর্বল হয়ে পড়ে, তখন মানুষ অন্য কোনো খাতে বিনিয়োগের চেয়ে যে বিনিয়োগ নিরাপদ ভাবে সেখানেই অর্থ রাখতে চায়। এসব ক্ষেত্রে সোনাকে বেছে নেয়ার প্রবণতা অনেক বেশি। কারণ সোনা অপেক্ষাকৃত নিরাপদ। কেননা সংকটে সবার প্রথমে প্রভাব পড়ে শেয়ার বাজার, বন্ড ও মুদ্রায়। শেয়ারবাজারে যেমন হঠাৎ ধস নামতে পারে, সোনার বেলায় তেমনটা নয়। তখন সোনা হয়ে ওঠে বিপদের বন্ধু।
সোনা অপেক্ষাকৃত নিরাপদ। সংকটে প্রথম প্রভাব পড়ে শেয়ার বাজার, বন্ড ও মুদ্রায়। শেয়ারবাজারে হঠাৎ ধস নামতে পারে, সোনার বেলায় তেমনটা নয়। তখন সোনা হয়ে ওঠে বিপদের বন্ধু। তেল বা গ্যাসের মতো সোনা কিন্তু ফুরিয়ে যায় না। বিভিন্ন হাত ঘুরে তা শেষ পর্যন্ত টিকে থাকে। তাই সোনার স্থায়িত্ব আছে।
অধ্যাপক সায়মা হক আরো বলেন, তেল বা গ্যাসের মতো সোনা কিন্তু ফুরিয়ে যায় না। বিভিন্ন হাত ঘুরে তা শেষ পর্যন্ত টিকে থাকে। তাই সোনার স্থায়িত্ব আছে। পৃথিবীতে সোনার মজুত নির্দিষ্ট পরিমাণেই রয়েছে। সাধারণত বাজারে কোনো পণ্যের দাম নির্ধারিত হয় চাহিদা ও যোগানের ভিত্তিতে। তবে সোনার দামের সঙ্গে যোগানের চেয়ে ভোক্তার আচরণ অনেক ক্ষেত্রে বেশি প্রভাব ফেলে।
বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতির (বাজুস) সভাপতি বলেন, আমাদের দেশে ২০১৮ সালে সোনা ব্যবসায়ীদের জন্য সরকার একটি নীতিমালা করে দিয়েছে। আমরা সোনার দাম বাড়ানো-কমানোর ক্ষেত্রে বিশ্ববাজার পর্যবেক্ষণের পাশাপাশি সরকার প্রণীত নীতিমালা অনুসরণ করি। এ কারণে সোনার দাম বাড়লে বা কমলেও ব্যবসায়ীদের লোকসানের পরিমাণ আগের চেয়ে অনেক কমেছে।
তিনি আরো বলেন, সরকার বিদেশি বিনিয়োগে উৎসাহিত করার জন্য দেশে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল তৈরি করছে। জুয়েলারি শিল্পের জন্যও একটি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল তৈরি করা হলে এ খাতের ব্যবসায়ীরা নিরাপদে ও সহজে ব্যবসার প্রসার ঘটাতে পারবেন।
বর্তমানে দেশের বাজারে সোনার দাম (২২ ক্যারেট) প্রতি ভরি ১ লক্ষ ৩৭ হাজার ৪৪৮ টাকা। যা চলতি বছরের ১৫ জানুয়ারি দেশের বাজারে সবচেয়ে বড় লাফ দেয় সোনা। প্রতি ভরি সোনার দাম দাঁড়ায় রেকর্ড ৯৩ হাজার ৪২৯ টাকায়। বর্তমানে দোদুল্যমান বিশ্ববাজারে সোনার দাম কিছুটা অস্থিরতায় থাকায় দেশে আরো এক দফা বাড়তে পারে বলে ধারণা করছে বাজুসের মূল্য নির্ধারণ ও মূল্য পর্যবেক্ষণ সংক্রান্ত স্থায়ী কমিটি।
0 মন্তব্যসমূহ