ঢাকা, বাংলাদেশের রাজধানী এবং একটি জনবহুল মহানগরী হিসেবে পরিচিত। এই শহরটির ইতিহাস, সংস্কৃতি এবং অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে যৌনকর্মীদের জীবন ও কার্যক্রমের দীর্ঘ এবং জটিল একটি ধারা রয়েছে। ঢাকার পতিতাদের জীবনকে কেন্দ্র করে যে সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং আইনি প্রেক্ষাপট গড়ে উঠেছে, তা শুধু একটি শহরের নয়, বরং বাংলাদেশের সমাজব্যবস্থার প্রতিফলন হিসেবে গণ্য করা যায়।
ইতিহাসের পটভূমি
ঢাকার পতিতাদের ইতিহাস ঔপনিবেশিক যুগ থেকে শুরু হলেও, এর গোড়াপত্তন আরও আগে, মুঘল শাসনের সময় থেকেই বিদ্যমান ছিল। ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক ও রাজনৈতিক কেন্দ্র হিসেবে বিকাশের ফলে, পতিতালয়গুলো শহরের কেন্দ্রীয় কিছু স্থানে গড়ে ওঠে। বিশেষ করে পুরনো ঢাকা এলাকায় পতিতালয়গুলোর উপস্থিতি ছিল।
ঔপনিবেশিক যুগে পতিতালয়ের বিস্তার
ব্রিটিশ শাসনকালে ঢাকা, বিশেষত পুরান ঢাকার কিছু এলাকা, যেমন—বাকরগঞ্জ, কে এম দাস লেন এবং লালবাগ, যৌনকর্মের কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠে। ব্রিটিশ সৈন্য, কর্মকর্তা এবং ব্যবসায়ীদের উপস্থিতির কারণে পতিতালয়গুলো আরো শক্তিশালী হয়। ব্রিটিশ প্রশাসন কখনো যৌনকর্মীদের কার্যক্রমে নিয়ন্ত্রণ আরোপের চেষ্টা করেছে, কিন্তু তা কখনো পুরোপুরি সফল হয়নি।
সামাজিক ও অর্থনৈতিক বাস্তবতা
পতিতাবৃত্তি সামাজিকভাবে স্বীকৃত নয় এবং এটি অত্যন্ত নিন্দনীয় বলে বিবেচিত হলেও, এটি সমাজের একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক বাস্তবতার অংশ। ঢাকায় অনেক নারী অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে পতিতাবৃত্তিতে যুক্ত হয়েছেন। গ্রামীণ দারিদ্র্য, যৌন নির্যাতন, পারিবারিক সমস্যার মতো সামাজিক এবং ব্যক্তিগত চ্যালেঞ্জগুলো তাদের এ ধরনের পেশা বেছে নিতে বাধ্য করে।
যৌনকর্মীদের জীবনের জটিলতা
ঢাকার পতিতাদের জীবন অত্যন্ত জটিল এবং কষ্টদায়ক। তারা সমাজের নানান স্তরের শোষণ এবং বৈষম্যের শিকার। তাদের জীবনযাত্রা সীমাবদ্ধ এবং অনেক ক্ষেত্রে তাদের মৌলিক অধিকারগুলো লঙ্ঘিত হয়। অধিকাংশ পতিতার জীবনে স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা এবং সামাজিক সুরক্ষার সুযোগ সীমিত।
স্বাস্থ্যগত চ্যালেঞ্জ: যৌনকর্মীদের স্বাস্থ্য ঝুঁকি অত্যন্ত বেশি। যৌনবাহিত রোগ, এইচআইভি/এইডসের মতো গুরুতর রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে। তাছাড়া, মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা, বিশেষ করে ট্রমা এবং হতাশা, তাদের জীবনে বড় ধরনের প্রভাব ফেলে।
অর্থনৈতিক শোষণ: অনেক পতিতা দালাল এবং যৌন ব্যবসায় জড়িত অন্যান্য ব্যক্তিদের দ্বারা অর্থনৈতিকভাবে শোষিত হন। তারা খুব কম মজুরির বিনিময়ে কাজ করতে বাধ্য হন এবং আর্থিকভাবে স্বাধীনতা লাভ করা তাদের জন্য কঠিন হয়ে পড়ে।
সামাজিক বিচ্ছিন্নতা: পতিতারা সমাজের প্রধান ধারায় অন্তর্ভুক্ত নন। তারা প্রায়শই সামাজিক বিচ্ছিন্নতার শিকার হন এবং তাদের সন্তানরাও একই ধরনের বৈষম্যের শিকার হয়।
আইনগত প্রেক্ষাপট
বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী পতিতাবৃত্তি অবৈধ নয়, তবে এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কার্যক্রম, যেমন—দালালির মাধ্যমে পতিতাবৃত্তি পরিচালনা, পতিতালয় চালানো এবং কম বয়সী মেয়েদের যৌন ব্যবসায় যুক্ত করা—আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। ফলে, পতিতাদের জীবন আইনগত জটিলতার মধ্যে আটকে থাকে।
আইনি সুরক্ষা ও বাস্তবতা
যদিও বাংলাদেশের আইন যৌনকর্মীদের জন্য মৌলিক মানবাধিকার নিশ্চিত করার কথা বলে, তবে বাস্তবে আইনি সহায়তা পাওয়া তাদের জন্য কঠিন। পুলিশি হয়রানি, সামাজিক নিপীড়ন এবং আইনগত সংস্থাগুলোর দমনমূলক আচরণ যৌনকর্মীদের জীবনে নতুন নতুন সমস্যার সৃষ্টি করে।
আধুনিক সময়ে পতিতাদের জীবন
বর্তমানে ঢাকায় যৌনকর্মীদের জীবন কিছুটা পরিবর্তনের মুখোমুখি। বিভিন্ন এনজিও এবং মানবাধিকার সংস্থা যৌনকর্মীদের অধিকার রক্ষায় কাজ করছে। তাদের মধ্যে স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা এবং নিরাপত্তার মতো মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণের চেষ্টা করা হচ্ছে।
সচেতনতা বৃদ্ধি: বর্তমান সময়ে যৌনকর্মীদের মধ্যে সচেতনতা বাড়ানোর জন্য বিভিন্ন প্রচারণা ও কর্মসূচি হাতে নেওয়া হয়েছে। তাদের মধ্যে যৌনবাহিত রোগ প্রতিরোধ এবং এইচআইভি/এইডস সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
আর্থিক সমর্থন: কিছু এনজিও যৌনকর্মীদের বিকল্প কর্মসংস্থান খুঁজে দেওয়ার জন্য প্রশিক্ষণ এবং অর্থনৈতিক সহায়তা প্রদান করছে, যাতে তারা এই পেশা থেকে বেরিয়ে আসতে পারেন।
উপসংহার
ঢাকার পতিতাদের জীবন শুধুমাত্র একটি সামাজিক সমস্যা নয়, বরং এটি একটি গভীর অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক বাস্তবতার প্রতিফলন। সমাজের নৈতিকতা, আইন এবং মানবাধিকার নিয়ে আলোচনা করতে গেলে যৌনকর্মীদের অবস্থানকে উপেক্ষা করা যায় না। তাদের জীবনমান উন্নয়নের জন্য সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি বদলানো এবং তাদের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি।
পতিতাদের জীবনকে একটি সম্পূর্ণ সামাজিক প্রেক্ষাপটে দেখতে হলে, আমাদের তাদের জীবনের বাস্তবতা সম্পর্কে সচেতন হতে হবে এবং তাদের পুনর্বাসন ও সুরক্ষার জন্য কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। তাদের জন্য সমাজে সুযোগ এবং সমতা নিশ্চিত করতে হলে, যৌনকর্মীদের মৌলিক মানবাধিকার সুরক্ষিত করা প্রয়োজন, যা কেবল আইনি ব্যবস্থা ও সামাজিক সচেতনতার মাধ্যমেই সম্ভব।
0 মন্তব্যসমূহ