কালিঘাটের পতিতাবৃত্তির ইতিহাস: এক ঐতিহাসিক ও সামাজিক বিশ্লেষণ


ভারতের পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী কলকাতা তার ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা, সংস্কৃতি ও বিভিন্ন সামাজিক দিকের জন্য সুপরিচিত। এরই একটি দিক হলো কলকাতার কালিঘাট এলাকায় অবস্থিত যৌনপল্লী। এটি কলকাতার অন্যতম প্রাচীন যৌনপল্লী হিসেবে সুপরিচিত, যা বহু শতাব্দী ধরে কলকাতার সামাজিক এবং অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে ভূমিকা পালন করে আসছে। কালিঘাটের এই পতিতাবৃত্তির ইতিহাস, সামাজিক প্রভাব, এবং এর পিছনের বাস্তবতাগুলি নিয়ে এই প্রবন্ধে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে।

ইতিহাস ও প্রতিষ্ঠা

কালিঘাট যৌনপল্লীর সূচনা হয়েছিল ব্রিটিশ শাসনামলে। ১৮শ এবং ১৯শ শতাব্দীতে ব্রিটিশরা যখন কলকাতাকে তাদের বাণিজ্যিক রাজধানী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছিল, তখন কলকাতা বিভিন্ন ধরণের পেশা ও বাণিজ্যের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়। বিভিন্ন ইউরোপীয় বণিক, সৈন্য এবং পর্যটকরা এখানে আসা শুরু করেন। বিদেশিদের আনাগোনার জন্য যৌনকর্মের চাহিদাও বৃদ্ধি পায়, এবং ধীরে ধীরে এই অঞ্চলটি একটি যৌনপল্লীতে রূপান্তরিত হয়। কালিঘাট মন্দিরের আশেপাশে প্রাথমিকভাবে নারীদের মাধ্যমে এই পেশার প্রসার ঘটে, যা কালক্রমে সমাজের এক অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়।

কালিঘাট মন্দিরের আশেপাশে যৌনপল্লীর এই প্রতিষ্ঠা সামাজিক এবং অর্থনৈতিক চাপের ফলেও হয়েছে বলে ধারণা করা হয়। বিশেষত, দরিদ্র পরিবার এবং অর্থনৈতিকভাবে অসহায় নারীরা এখানে কাজ করতে বাধ্য হন, যেহেতু এটি ছিল একটি আয়ের সহজ উপায়। পাশাপাশি, স্থানীয় দালাল এবং বিভিন্ন অসাধু ব্যক্তি এই পরিস্থিতিকে কাজে লাগিয়ে এখানে একটি সংগঠিত পেশা গড়ে তোলেন।

ব্রিটিশ শাসনের প্রভাব

ব্রিটিশ শাসনের সময়কালেই এই যৌনপল্লীর প্রসার ঘটে। ব্রিটিশরা কলকাতাকে একটি বাণিজ্যিক কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার ফলে এখানে বিভিন্ন শ্রেণি এবং জাতিগোষ্ঠীর মানুষ বসবাস শুরু করেন, যার মধ্যে ছিল ব্যবসায়ী, শ্রমিক, এবং সেনাবাহিনীর সদস্যরা। এসময়ে নারীদের অর্থনৈতিক স্বাধীনতার অভাব এবং পুরুষতান্ত্রিক সমাজের অবস্থা নারীদেরকে যৌনকর্মে প্রবেশ করতে বাধ্য করে।

ব্রিটিশরা এক সময় আইনত যৌনকর্মের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করলেও পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি। বেশ কিছু তথ্যে জানা যায় যে, ব্রিটিশ সৈন্যদের মধ্যে যৌনরোগ ছড়িয়ে পড়া ঠেকানোর জন্য ব্রিটিশ সরকার কালিঘাট এবং এর আশেপাশের যৌনকর্মীদের জন্য নিয়ম-কানুন প্রতিষ্ঠা করেছিল। তবে, এসব ব্যবস্থা কার্যকরভাবে তেমন প্রভাব ফেলেনি।

সামাজিক এবং অর্থনৈতিক প্রভাব

কালিঘাট যৌনপল্লী শুধু কলকাতার অর্থনীতিতেই নয়, স্থানীয় সমাজের বিভিন্ন স্তরে প্রভাব ফেলেছে। এখানকার যৌনকর্মীরা তাদের জীবিকা নির্বাহের জন্য এই পেশাকে বেছে নেয়, যা তাদের জন্য বেঁচে থাকার একটি মাধ্যম। তবে, সমাজে তাদের গ্রহণযোগ্যতা এখনও চ্যালেঞ্জের মুখে। কালিঘাটের যৌনপল্লী স্থানীয় বাজার, ছোট ব্যবসা এবং খাবারের দোকানগুলোর জন্য আর্থিক উৎস হিসেবে বিবেচিত।

এছাড়াও, অনেক নারী এখানে বিভিন্ন রোগ ও মানসিক সমস্যায় ভুগে থাকেন, এবং তাদের জন্য সঠিক স্বাস্থ্যসেবা ও সুরক্ষা ব্যবস্থা প্রয়োজন। বেশ কয়েকটি এনজিও এবং সমাজসেবী সংস্থা এখানে কাজ করছে, যারা যৌনকর্মীদের স্বাস্থ্য, শিক্ষা, এবং বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে চেষ্টা চালাচ্ছে।

ধর্মীয় স্থান এবং যৌনপল্লীর সহাবস্থান

কালিঘাট মন্দির, যা হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের কাছে একটি অত্যন্ত পবিত্র স্থান, তার কাছেই এই যৌনপল্লীর অবস্থান অনেকের কাছেই বৈপরীত্যপূর্ণ মনে হয়। ধর্মীয় এবং সামাজিক বাস্তবতার এই সহাবস্থান কালিঘাটের জন্য একটি স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য তৈরি করেছে। এই সহাবস্থানের ফলে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংঘর্ষও সৃষ্টি হয়। তবে, কালিঘাট মন্দির এবং যৌনপল্লীর এই সহাবস্থান প্রমাণ করে যে, ধর্মীয় পবিত্রতা এবং মানব জীবনের কঠিন বাস্তবতা কিভাবে একসাথে থাকতে পারে।

বর্তমান পরিস্থিতি এবং পুনর্বাসনের প্রচেষ্টা

বর্তমানে কালিঘাট যৌনপল্লীতে স্থানীয় প্রশাসন এবং এনজিওরা যৌনকর্মীদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের জন্য কাজ করছে। এখানে স্বাস্থ্যসেবা প্রদান, বিভিন্ন সচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনা এবং শিশুদের শিক্ষার ব্যবস্থা করা হয়। সমাজসেবী সংস্থাগুলি তাদের বিকল্প কর্মসংস্থানের জন্য বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কার্যক্রম পরিচালনা করে, যাতে তারা এই পেশা ছেড়ে সমাজে মুলধারায় ফিরে আসতে পারেন।

তবে, এখানে এখনও অনেক সমস্যা রয়ে গেছে। যৌনকর্মীদের প্রতি সামাজিক বৈষম্য, আর্থিক অনিশ্চয়তা এবং স্বাস্থ্য ঝুঁকি তাদের জন্য এখনও বড় চ্যালেঞ্জ। কালিঘাট যৌনপল্লী নিয়ে প্রশাসনও নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করছে, তবে এটি পুরোপুরি বিলুপ্ত করতে এখনও অনেক বাধা রয়েছে।

উপসংহার

কালিঘাটের যৌনপল্লীর ইতিহাস একটি বহুমুখী এবং জটিল ইতিহাস, যা ধর্মীয় তীর্থস্থান এবং যৌনপল্লীর সহাবস্থানের মাধ্যমে একটি বিশেষ সামাজিক বৈপরীত্য তৈরি করেছে। অর্থনৈতিক অসহায়ত্ব, পুরুষতান্ত্রিক সমাজ, এবং বিদেশি শাসনের সময়কালে এখানকার নারীরা এই পেশায় প্রবেশে বাধ্য হয়েছিলেন, যা তাদের জন্য আর্থ-সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে বেঁচে থাকার একটি মাধ্যম হয়ে দাঁড়ায়। কালিঘাট যৌনপল্লী ভারতের সামাজিক বাস্তবতার একটি প্রামাণ্য উদাহরণ হিসেবে বিবেচিত।




রেফারেন্স
১. Ray, Bharati. Early Feminists of Colonial India. Oxford University Press, 2002.
২. Banerjee, Sumanta. Under the Raj: Prostitution in Colonial Bengal. Chronicle Books, 2000.
৩. Sarkar, Tanika. Words to Win: The Making of Amar Jiban, a Modern Autobiography. Kali for Women, 1999.
৪. Basu, Srimati. "Politics of Prostitution in Colonial Bengal," Social Scientist, Vol. 23, No. 9/10, 1995, pp. 48–61.

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ