চারপাশ নিয়ন আলোতে ভরপুর, চলছে নাচ গান, পাশে হাটছে সুন্দরী নারী , সামনে ক্যাসিনো টেবিল আর পাশে জুয়ারী।নেই নিয়ম নেই কোনো নীতি, নেই কোনো বাধা নেই কোনো বিপত্তি , বলা হয় তাকে প্রমোদ নগরী। কি ভাবছেন এমন ও কি আবার কোনো জায়গা আছে নাকি? নাকি শুধুই কোনো মানুষের জল্পনা কল্পনা?
না, এটি মোটেও কোনো জল্পনা কল্পনা নয় বরং যুক্তরাষ্ট্রের নেভাডা অঙ্গরাজ্যের ঠিক এমনই একটি শহর লাস ভেগাস। শুধুমাত্র শহর বললে ভুল হবে, পৃথিবীর সবচেয়ে বড় পাপ আড্ডা হয় আমেরিকান শহর লাসভে গাসকে। কি নেই এখানে? জুয়া, মদ, দেহব্যবসা আর ক্যাসিনোতে ঠাসা পুরো শহর । আকাশচুম্বী উঁচু দালান, যেখানে তাকানো যায় সেখানেই শুধু আলো আর আলো। বাহ্যিক চাকচিক্যের নেই কোনো অভাব। আপনি চাইলেই এখানে যেভাবে ইচ্ছে সে সেভাবেই চলতে পারবেন, যা ইচ্ছে তাই খেতে পারবেন। এমনকি যেমন ইচ্ছে তেমন কাপড় ই পড়তে পারবেন। তবে হ্যা, মদ খেতে একদমই মাতলামো করা যাবেনা কিন্তু।
তাছাড়া পৃথিবীর অনেক ধনী ব্যক্তিদের ধনী হবার কারণ হয়েছে এই লাস ভেগাস । শুধু তাই নয় কেউ কেউ নিজের ব্যবসা বাঁচাতে ও লাস ভেগাসে খেলেছে ক্যাসিনো। আজকের দিনের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পে র এতো উন্নতির পিছনেও রয়েছে লাস ভেগাস এর অবদান।আর তাই এই প্রবন্ধটিতে জানবো এই লাস ভেগাসের অন্দরমহলের সব খবর । তাহলে চলুন জেনে নেওয়া যাক।
ইতিহাসের পাতায় ভেগাস নগরী
লাস ভেগাসের জন্ম ১৯০৫ সালে হলেও , চল্লিশ শতক পর্যন্ত এর অগ্রগতি ছিলো না চোখে পড়ার মতো না। কিন্তু তার পরের এক যুগের মধ্যেই রাতারাতি বদলে যেতে শুরু করে লাস ভেগাস। তখনকার সময়ের নিউ ইয়র্ক ও শিকাগোর একদল মাফিয়া রা তাদের অবৈধ পথে অর্জিত কালো টাকা সাদা করার লক্ষ্যে বেছে নেয় উদীয়মান শহর লাস ভেগাস কে। কেননা, এই অঞ্চলটি ছিলো মরুভূমির (মোহাভি মরুভূমির)।
তাই লোক সংখ্যা কম হওয়াতে কোনো নিয়ম নীতি না থাকায় আস্তানা গড়ে তুলতে মোটেও ঝামেলা পোহাতে হয়নি তাদের। ক্যাসিনো , মদ, জুয়া , পতিতাবৃত্তি সব ই গড়ে উঠে এই মরুভূমির শহরে। আর তাই নিজেদের ব্যবসা ক্ষেত্রে উন্নতি হতে থাকার কারণে স্থানীয় বাসিন্দারা কখনোই এই ক্ষেত্রে বাধা আক্ষেপ পোষণ করেনি। বলা বাহুল্য, শিকাগোর মাফিয়ারা লাস ভেগাসে পৌঁছানোর পূর্বেই সেখানে আস্তানা গড়ে বসে ছিলো নিউ ইয়র্কের মাফিয়ারা। আর তখনই তারা তাদের অবৈধ অর্থ সম্পদ লুকানোর জন্যে শুরু করে ব্যবসা বানিজ্য। সমগ্র আমেরিকা তে এই সকল ব্যবসা বাণিজ্য বৈধ হিসেবে গণ্য না হলে ও লাস ভেগাসের কোনো নিয়ম নীতি না থাকায় এটি বৈধ বলেই গণ্য হতো। আর এই সকল অবৈধ ক্যাসিনো ও হোটেল ব্যবসা থেকে ই প্রতি বছর প্রায় ৫ কোটি ডলার মুনাফা আসতো।
নিউ ইয়র্কের সাথে শিকাগো মাফিয়াদের মধ্যে পূর্ববর্তী বন্ধুত্ব থাকায় তাদেরকেও ব্যবসায়ে সামিল করে নেয় নিউ ইয়র্কের মাফিয়ারা। এক পর্যায়ে এই দুই গোষ্ঠী মিলে গড়তে থাকে পাপের এক বৃহৎ ব্যবসায়িক আস্তানা । ফলে বাহির থেকে আগত বিপুল পরিমাণে মানি লন্ডারিং এর টাকাগুলো এখানে রূপান্তরিত হতে থাকে বৈধ টাকায়, এরই মধ্যে দিয়ে অর্থ পাচারের রাজধানী হয়ে উঠে লাস ভেগাস। এই দুই মাফিয়াগোষ্ঠী দের সমন্বয়ে বড়ো বড়ো ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠার পর মাত্র ২ বছরের মধ্যে চার কিলোমিটার নেভাডা মরুভূমির চেহারাই বদলে যায়। চমক প্রবণ হোটেল ও ক্যাসিনো ব্যবসা গড়ে তুলে তাদের দ্বারা এক নতুন ইতিহাস তৈরি হয় সেটিই আজকে লাস ভেগাস স্ট্রিপ নামে পরিচিত।
১৯৫০ এর শেষের দিকে প্রায় ৮০ লাখের ও বেশি পর্যটক ঘুরতে আসে মোহনীয় শহরলাসভেগাসে। বিপুল পরিমাণ এই পর্যটক লাস ভেগাসের ক্যাসিনো তে প্রায় ২০ কোটি মার্কিন ডলার খরচ করে। । পরবর্তীতে এই পর্যটক টিকিয়ে রাখতে তাদের মনোরঞ্জনের জন্যে মাফিয়ারা হলিউড তারকা দের আমন্ত্রণ জানায় এইসব ক্যাসিনো গুলোতে। এভাবেই লাস ভেগাস এক সময় পরিণত হয় হলিউড তারকাদের মিলনমেলায়।
আর এই সুযোগে ই তৎকালীন বিশ্বের সবচেয়ে বড়ো এই মাফিয়া দল অর্থ পাচারের নতুন নতুন উপায় বের করতে থাকে । আর এভাবেই সকল প্রকার অর্থ পাচার, পতিতাবৃত্তি বিভিন্ন খারাপ কাজ যখন এখানে বৈধতা অর্জন করে ঠিক তখনই এর নামকরণ করা হয় দি সিন সিটি অথবা পাপের নগরী।
হোয়াট হেপেন্স ইন ভেগাস স্টেস ইন ভেগাস
এই ট্যাগ লাইনটি পর্যটন ব্যবসায়ে র অন্যতম বিখ্যাত একটি ট্যাগ লাইন যা কিনা ব্যবহৃত হয়েছে হলিউডের অনেক বিখ্যাত সিনেমা তে ও। অবাক করার মতো হলেও সত্যি কিন্তু এই এক লাইন বাক্যের মোহ তে লক্ষ্য লক্ষ্য মানুষ ছুটে এসেছে সিন সিটি বা পাপের শহর নামে বিখ্যাত লাস ভেগাসে।
নেভাডা অঙ্গরাজ্যের অন্তর্গত যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ শহর গুলোর ২৮ তম । আন্তর্জাতিক ভাবে এই রিসোর্ট নগরী বিখ্যাত হবার মূলে রয়েছে জুয়ার আসর, বহুমুখী বিনোদন ও নৈশ প্রমোদের কারণে। এক কথায় বলতে গেলে , লাস ভেগাস উপত্যকাটি এমন একটি বানিজ্যিক ও সংস্কৃতির কেন্দ্র যেখানকার হাওয়ায় মানুষ মুক্তির স্বাদ গ্রহণ করতে আসে।
তাছাড়া এটা নিজেরাই নিজেদেরকে বিশ্ব বিনোদনের রাজধানী হিসেবে দাবি করে। আকাশচুম্বী ক্যাসিনো ওয়ালা হোটেল গুলোতে প্রতিবছর যুক্তরাষ্ট্রের বৃহৎ বানিজ্যিক সম্মেলন গুলো হয়ে থাকে যার সংখ্যা প্রায় ২২০০০ হাজার ছাড়িয়ে যায়। এই শহরের লোকজন জুয়ার মধ্যে এতটাই আসক্ত ছিলো যে তারা যেকোনো বিষয় নিয়েই বাজি ধরতে দ্বিধা করতো না। জানা যায়, ১৯৮০ সালে র দিকে লাস ভেগাস হাসপাতালের কর্মীরা রোগীদের উপর বাজি ধরতো যে কোন রোগীর কখন মৃত্যু হবে। এমনকি এক নার্স বাজিতে জিতার জন্যে এক রোগীকে হত্যা পর্যন্ত করে। ফলে হাসপাতালের বেশ কিছু কর্মীকে চাকরী থেকে বরখাস্ত করা হয়।
পৃথিবীর সবচেয়ে বড় হোটেল গুলোর মধ্যে প্রায় ২০ টির অবস্থানই লাস ভেগাসে। তাছাড়া বিনোদনের এই নগরীতে সর্বমোট যে কয়টি হোটেল আছে টা সম্পূর্ণ ঘুরে দেখতে হলে একজন মানুষের সময় লাগবে ২৮৮ বছর । এমনি এমনি ই আর এই পাপের নগরী সেরা পর্যটন কেন্দ্রে পরিণত হয় নি।
এই শহরের নাম পাপের নগরী হলেও এখানে পতিতাবৃত্তি এখন অবৈধ। তবে ভারতীয় উপমহাদেশে জুয়া খেলাকে নেতিবাচক ভাবে দেখলে ও পশ্চিমা দেশগুলোতে এটি খুবই স্বাভাবিক। জুয়া খেলে নিঃশেষ হতে হয় এটা যেমন সত্যি তেমনি এই জু য়া খেলেই নিজের ডুবন্ত নৌকা পারে তুলেছিলো কোরিয়ার আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন কোম্পানি FedEx এর প্রতিষ্ঠাতা ফ্রেডরিখ স্মিথ । মাত্র ৫০০০ ডলার নিয়ে লাস ভেগাসে আসলেও ২৭০০০ ডলার জিতে ফিরেন যার মধ্য থেকে ২৪০০০ ডলার দিয়ে তার কোম্পানির জ্বালানি বিল দেয়।তবে ক্যাসিনোতে একটি ব্লাকবুক রয়েছে এর মধ্যে থাকা কোনো লোকই ভেগাসে প্রবেশ করতে পারবেনা।
মনোমুগ্ধকর ভেগাস নগরী
মনোমুগ্ধকর এই নগরীতে ঘুরে দেখলে দেখা যাবে অনেক কৃত্রিম ঝর্না ।যার উৎপত্তি হয়ে থাকে সিঙ্ক , বাথটাব কিংবা গোসল খানায় ব্যবহৃত পানিকে প্রক্রিয়াজাত করণের মাধ্যমে। আর এই ঝরনার পানিকে বলা হয় গ্রে ওয়াটার। ভেগাস নগরী এতো টাই আলোকিত যে মহাকাশ থেকে এই স্থানটি দেখা যায়।তাই ভেগাসের সৌন্দর্য মূলত রাতেই। সারারাত ই জ্বলতে থাকে মিলিয়ন মিলিয়ন বাতি। কিন্তু সবচাইতে মুগ্ধকর বিষয়টি হলো রাস্তার বাতি, সরকারি দালান , পার্ক এইসব খানেই ব্যবহার করা হয় পুনঃ নবায়নযোগ্য শক্তি।পৃথিবীর অধিকাংশ দেশে মদ খেয়ে মাতলামি করা অপরাধ হলেও এখানে সেটি অপরাধ না তবে সেটি যদি কারো ক্ষতির কারন হয়ে দাড়ায় তবে তা শাস্তি যোগ্য অপরাধ বলে বিবেচিত হবে।
ছোটবেলায় বৃহৎ ভাবগাম্ভীর্যের খেলনা গাড়ির নিয়ে খেলার প্রতি অনেক মানুষেরই ঝোঁক থাকে কিন্তু বড়ো হবার পর সেই সব আর বয়সের সাথে যায় না।তবে বিনোদনের জন্যে আপনি চাইলেই এখানে ৯০ মিনিট থেকে ৩ ঘণ্টা চালাতে পারবেন বুলডোজার বা খননকারী গাড়ী। শুধু মাত্র ছোটো খা টো ট্রেইনিং আর পরীক্ষার মাধ্যমে আপনি উত্তীর্ণ হলেই আপনাকে দেয়া হবে এই সুবর্ণ সুযোগ।
ভেগাসে সব মানুষই যে জুয়া কিংবা ক্যাসিনো খেলতে যায় টা কিন্তু না। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে মোট পর্যটকদের মাত্র ১৭% জুয়া বা ক্যাসিনোর উদ্দেশ্যে গেলেও বাকিরা আসে এর বিভিন্ন কারনে । তবে ৫০ দশকের পর্যটকদের এখানে বেড়াতে আসার মূল কারণ ছিলো এখান থেকে আণবিক বোমার বিষ্ফোরণ দেখা। যুক্ত রাষ্ট্রের শক্তি বিভাগ ১৯৫১ সালের দিলে ভেগাস থেকে ৬৫ মাইল দূরে আণবিক যন্ত্রের পরীক্ষা চালায়। এর দরুন মাশরুমের মত ধোয়া সৃষ্টি হতো যা পর্য টকদের জন্যে ছিলো বেশ আকর্ষণীয়।
এই শহরের দারিদ্রতাকে আড়াল করে রাখা হয়। এই নগরীর নিচে রয়েছে ২০০ মাইল টানেল যেখানে বসতি রয়েছে দিন মজুর , ভিক্ষুক , গৃহহীন মানুষে রা। বিলাসহুল মানুষের পরিত্যাক্ত খাবার খেয়েই বেচে আছে আন্ডার গ্রাউন্ডের এই সমাজ।
বিশ দশকের ভেগাস নগরী
২০ দশকে এসে অবাক করার মতো হলেও লাস ভেগাস এখন মুসলিমদের বসবাসের নগরীতে পরিণত হচ্ছে। লাস ভেগাসের একটি মসজিদের অঞ্চলকে ঘিরেই গড়ে উঠেছে মুসলিম গোষ্ঠীর বসবাস। এই মসজিদের ইমামের অবদানেই গড়ে এই মুসলিম কমিউনিটি। আর এই স্থানের নামকরণ করা হয়েছে “মুসলিম ভীলেজ”। বর্তমানে এই স্থানটি কে সবাই শান্তির স্থান মনে করেন এবং সেখানে গিয়ে প্রার্থনা ও করে। জানা গেছে সেখানকার অনেক মানুষ ইসলাম গ্রহণ করেছে। তবে সস্তির বিষয় এখন সেখানে নিয়ম কানুন তৈরি হচ্ছে। কঠোর হচ্ছে আইন ব্যবস্থাও।ভেগাস নগরীর এই পরিবর্তন সত্যিই চোখে পড়ার মতো। পৃথিবীর সব দেশেই এভাবে প্রতিষ্ঠা হোক শান্তি শৃঙ্খলা ও উন্নতি।
0 মন্তব্যসমূহ