বাংলাদেশের আজব মেলা, মেলায় পাওয়া যায় জীবন সঙ্গী, পছন্দ হলেই বিয়ে



মেলার নাম মিলনমেলা। এ মেলায় পছন্দের জীবনসঙ্গীর খোঁজার জন্য আদিবাসী নারী-পুরুষরা সমবেত হতো। জীবনসঙ্গী পছন্দ হলেই ধর্মীয় শাস্ত্র মতে হয়ে যেত বিয়ে। কালের পরিক্রমায় প্রকাশ্যে এভাবে বিয়ে না হলেও আদিবাসীদের মিলনে এখনও অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে এ মেলা। প্রায় ২০০ বছরের ঐতিহ্যবাহী আদিবাসীদের এ মেলা হয়ে আসছে দিনাজপুর জেলার বীরগঞ্জ উপজেলার গোলাপগঞ্জে। মঙ্গলবার গোপালগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে দিনব্যাপী এ মেলা অনুষ্ঠিত হয়।


প্রায় ২০০ বছর ধরে এ মেলার আয়োজন করছে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মানুষ। সাধারণত দুর্গাপূজার বিজয়া দশমীর পরদিন এ মেলা বসে। আদিবাসী নৃ-গোষ্ঠীর তরুণ-তরুণীদের পাশাপাশি সনাতন ও ইসলাম ধর্মাবলম্বী মানুষও উপস্থিত হয় এ মেলায়।


স্থানীয় প্রবীণ বাসিন্দারা জানায়, আগে মেলায় তরুণ-তরুণীরা পছন্দের মানুষ খুঁজে পেলে পরিবারের কাছে জানাত। পরের বছর মেলায় তাদের নাম-পরিচয় তুলে ধরে বিয়ের আয়োজন করা হতো। এখনো অনেকেই মেলায় ছেলেমেয়ের জীবনসঙ্গী খুঁজে পেলে হয়তো বিয়ে দেয়। তবে আগের মতো বিয়ে না হলেও ঐতিহ্য ধরে রেখেছে আয়োজকরা।


মিলনমেলা ঘিরে নানা পণ্যের পসরা নিয়ে বসে বিক্রেতারা। বিদ্যালয়ের মাঠসহ পুরো গোলাপগঞ্জ বাজার এলাকা পরিণত হয় জনসমুদ্রে। জিলাপি, নিমকি, পিঠা, ফুচকা, চটপটিসহ বিভিন্ন খাদ্যসামগ্রীর দোকানের পাশাপাশি মেয়েদের অলঙ্কারের দোকান, শিশুদের খেলনাসামগ্রী, গৃহস্থালির নানা সরঞ্জাম, তৈজসপত্র, মাটির তৈরি জিনিসসহ দেড় সহস্রাধিক দোকান বসে এ মেলায়।

মেলা উপলক্ষে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ছুটে আসে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মানুষ। দিনাজপুর ছাড়া পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, নীলফামারী, জয়পুরহাট, নওগাঁ, বগুড়া জেলা থেকেও অনেক মানুষ মেলায় আসে। মেলা উপলক্ষে বিদ্যালয়ের মাঠে বসে নাচ-গানের আসর। ঢোল, মন্দিরা, কাঁসর, কাড়া, হারমোনিয়ামের তালে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর ছেলেমেয়েরা দলীয় ও এককভাবে তাদের ঐতিহ্যবাহী নৃত্য পরিবেশন করে।

দীর্ঘ প্রায় ২০-৩০ বছর থেকে এই মেলাটি প্রকাশ্যে জীবনসঙ্গী খোঁজার ঐতিহ্য থেকে সরে এসে মূলত পার্শ্ববর্তী কয়েকটি জেলার আদিবাসীদের ইতিহাস ঐতিহ্য তুলে ধরে একত্রিত হওয়ার উপলক্ষ হিসেবে উদযাপিত হয়ে আসছে। 


চিরিরবন্দর থেকে আসা আদিবাসী এক দম্পতি জানান, তারা উপভোগ করার জন্য এসেছেন মেলায়।

বীরগঞ্জের আদিবাসী যুবক স্যামুয়েল মুর্মু বলেন, ‘এই মেলা আদিবাসীদের ঐতিহ্যবাহী মেলা। প্রায় ২০০ বছর ধরে এই মেলা হয়ে আসছে। এই মেলায় প্রায় সকল আত্মীয়-স্বজন মিলে আমরা আসি। খুব উপভোগ করি। অনেকদিন পর আমরা একত্রিত হই। অনেকেই বলে এই মেলায় জীবনসঙ্গী খুঁজে পাওয়া যায়।’ 

তবে নীলফামারী থেকে আসা তরুণ মাইকেল বলেন, ‘গত বছর এই মেলায় জীবনসঙ্গী খুজতে এসেছিলাম পাইনি। এ বছরে খুঁজতে এসেছি। এখনো খুঁজতেছি। মেলাটি অনেক সুন্দর।’ 


মেলার একপাশে ঐতিহ্যবাহী নাচ ও গানের আসর। অন্যপাশে চলছে তরুণ-তরুণীদের জীবনসঙ্গী বাছাই। জেলার কাহারোল উপজেলা থেকে আসা সনাতন সরেন জানান, একটা সময় এই মেলায় জীবনসঙ্গী খুঁজে নেওয়ার প্রচলন ছিল। তবে আধুনিকতার ছোঁয়ায় সব বদলে গেছে। এখন এই রীতিতে ভাটা পড়েছে।

উপজেলার পৌরসভার ৯ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা জোসেফ হাসদা জানান, সময়ের সঙ্গে আদিবাসীদের জীবনযাত্রার মান এখন অনেক পরিবর্তন হয়েছে। বেশিরভাগ আদিবাসী ছেলে-মেয়ে এখন স্কুলমুখী হয়েছে। কালের বিবর্তনে পুরোনো ঐতিহ্যগুলো অনেকটাই মুছে যেতে বসেছে।

মেলা আয়োজক কমিটি বীরগঞ্জ থানা আদিবাসী সমাজ উন্নয়ন সমিতির সহ-সভাপতি এডয়ার্ড হেমরম জানান, গোলাগঞ্জ আদিবাসী মিলন মেলাটি ২০০ বছর পূর্ব থেকেই হয়ে আসছে। মেলাটি প্রতিমা বিসর্জনের বিজয়া দশমীর পরের দিনে অনুষ্ঠিত হয়। এখানে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আদিবাসী ছেলেমেয়েসহ নানা বয়সের মানুষজন আসেন। বিশেষ করে তরুণ-তরুণীরা তাদের আপন সঙ্গীকে চিহ্নিত করতে এবং পরবর্তীতে এটি সামাজিক ও পারিবারিকভাবে বিবাহ সম্পন্ন করা হয়। 

তিনি জানান, পূর্বপুরুষের আমল থেকে এই মেলা চলমান। আমরা শুধু তার ধারাবাহিকতা রক্ষা করে যাচ্ছি। তবে কবে থেকে এ মেলার প্রচলন শুরু হয়েছে, সেটি সঠিকভাবে বলা যাবে না। বাপ-দাদার কাছে শুনেছি দুইশত বছর ধরে এ মেলা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ