‘আমার মতো লোকের পাল্লায় পড়লে তোমার কী হবে? সে তো গায়ের জোরেই তোমাকে শুইয়ে দেবে।’ এমন কথা শুনে ঘুরে দাঁড়িয়েছিল ছেলেটা। চকচক করে উঠেছিল তার চোখ, ‘আমি আপনাকে চ্যালেঞ্জ করছি না ভাই। কিন্তু আমিও হালুয়া নই।’
উচ্চতায় ৫ ফুট ৪ ইঞ্চি। রোগাপাতলা ছোকরার মুখে এমন প্রত্যুত্তর শুনে অবাক হননি খালিদ খান। জানতেন, ছেলেটার এই একরোখা ভাব স্রেফ কথার কথা নয়। এ সত্যিই সাঙ্ঘাতিক। নাহলে ডোংরির মতো ছোট এলাকা থেকে উঠে আসা একটা ছেলে, যার বাবা মুম্বাই পুলিশের হেড কনস্টেবল, সে এমন নিপুণ দক্ষতায় রামপুরী চাকু চালাতে পারত না। সময়টা গত শতকের সাতের দশকের। দশাসই চেহারার পালোয়ান খালিদের কাছে প্রশিক্ষণ নিয়ে নিজেকে গড়ে তুলেছে ছেলেটি।
সেদিন তাকে শেখাতে শেখাতে ঘুণাক্ষরেও ভাবতে পারেননি খালিদ, একদিন এই ছেলেটা হয়ে উঠবে বিশ্বত্রাস এক সমাজবিরোধী। তার অপরাধের পাল্লা ভারী হয়ে উঠবে এমন যে, দেশ ছেড়েই পালাতে হবে। অবশ্য তা বলে পলাতকের জীবন মোটেই কাটাচ্ছে না সে। একথা মোটামুটি সকলেরই জানা, পাকিস্তান তাকে রাজার হালে রেখে দিয়েছে। দেখতে দেখতে ৬৬ বছর বয়স হয়ে গেছে। আজও অধরা ডি কোম্পানির বেতাজ বাদশা দাউদ ইব্রাহিম। কেন তাকে ভারতে ফেরানো গেল না? আদৌ কি কোনোদিন ফেরানো যাবে? প্রশ্নগুলো সহজ নয়। উত্তরও অজানাই। কেবল তা হাতড়িয়ে দেখা যেতে পারে।
তবে তার আগে একটু ফ্ল্যাশব্যাকে যাওয়া দরকার। একবার ছুঁয়ে আসা প্রয়োজন ইব্রাহিম কাসকারের ছেলের মুম্বাইয়ের অপরাধী চূড়োমণি হয়ে ওঠার ধাপগুলোকে। মুম্বাই আন্ডারওয়ার্ল্ডের সূচনা সেই ছয়ের দশকে। বাণিজ্যনগরীর বুকে গজিয়ে উঠতে থাকা স্মাগলিং ও অন্যান্য অপরাধমূলক কাণ্ডকারখানা ততদিনে বেশ সাংগঠনিক চেহারা নিতে শুরু করেছে।
মুম্বাইয়ে সেই সময়ে নানা ছোট-বড় দল ছিল। দিশি পিস্তল, ছুরি, লাঠি, বোমা নিয়ে পাড়ায় পাড়ায় গ্যাংগুলোর মধ্যে মারামারি লেগেই থাকত। সেই সময়ের একনম্বর ডন ছিল ভরত রাজন নামের এক দক্ষিণ ভারতীয়। মুম্বাইয়ের বড় বড় ট্রেড ইউনিয়নগুলোতেও নাকি তার বিরাট প্রভাব ছিল। বলা হয়, সেই সময় আরবসাগরের পারের অপরাধ দুনিয়ায় দক্ষিণ ভারতীয়দেরই পাল্লা ভারী ছিল।
ঠিক সেই সময়ই অপরাধ দুনিয়ায় হাতেখড়ি হচ্ছে দাউদের। সপ্তম শ্রেণির বেশি পড়াশোনা এগোয়নি। স্কুলে নিত্যদিন মারামারি করে বেড়াতো সে। দাদা সাবির ইব্রাহিম কাসকরও তেমনই। তারা দু’জনে মিলে সংগঠিত ভাবে অপরাধমূলক কাজ শুরু করে দিয়েছিল। প্রথমে বাসু দাদা নামে এক স্থানীয় গুন্ডার হয়ে নানা রকম ছুটকো ছাটকা কাজ। সেখান থেকেই ক্রমে পাকাপোক্ত অপরাধী হয়ে ওঠা মুম্বাই পুলিশের সৎ কনস্টেবলের দুই ছেলের! এ এক আশ্চর্য প্রহসন।
হুসেন জাইদি ভারতের এক অতি বিখ্যাত ক্রাইম রিপোর্টার। ‘ব্ল্যাক ফ্রাইডে’র মতো বইয়ের লেখক তিনি। ৫৩ বছর বয়সী সেই সাংবাদিক দাউদ নিয়ে বিস্তর গবেষণা করেছেন। তিনি জানাচ্ছেন, এই সময়ই ‘মেন্টর’ খালিদ পালোয়ানের কাছে হাতেকলমে অপরাধী হওয়ার পাঠ নিয়েছিল দাউদ। এরপর সে গিয়ে জুড়ে যায় হাজি মস্তানের সঙ্গে।
ততদিনে ভরত রাজনকে সরিয়ে দিয়ে হাজি মস্তান হয়ে উঠেছে এক নম্বর ডন। তবে তার গ্যাংয়ের সঙ্গে জোর টক্কর ছিল পাঠান গ্যাংয়ের। সেই দলও ছিল সাংঘাতিক। তাদের হাতেই খুন হতে হয় সাবিরকে। এর বদলা নিয়েছিল দাউদ। প্রায় একার পরিকল্পনাতেই ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছিল পাঠান গ্যাংকে। এরপর হাজি মস্তান রাজনীতির দিকে চলে গেলে সমস্তা ক্ষমতার নিউক্লিয়াস হয়ে ওঠে একা দাউদ। মুম্বাইয়ে শুরু হয় এক নয়া অন্ধকার যুগ।
যদিও তখন থেকেই দুবাইয়ে বসবাস শুরু করে দিয়েছে দাউদ। সেখান থেকেই চালাচ্ছে ডি কোম্পানি। ছোটা রাজনের মতো সঙ্গীদের নির্দেশ দিচ্ছে মরুদেশ থেকেই। বলা হয়, সেই সময় দাউদের ভয়ে কাঁপতো গোটা মুম্বাই। ভেতরে ভেতরে সমাজের প্রভাবশালীদের সঙ্গেও ছিল তার ওঠাবসা। এমনকি, পুলিশের ভেতরেও তার ‘সোর্স’ ছিল। ‘দাউদ ভাই’ ছিল আতঙ্কেরই অপর নাম।
এরপর আসে ১৯৯৩ সালের ১২ মার্চ। সেই ‘কালো শুক্রবারে’ দেশের প্রথম সন্ত্রাসবাদী হামলায় কেঁপে উঠেছিল মুম্বাই। মোট ১৩টি বোমা বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। যাতে মৃত্যু হয় ২৫৭ জনের। আহত হন ৭১৩ জন। কেবল মুম্বাই নয়, গোটা ভারতই কার্যত থরথরিয়ে উঠেছিল মৃত্যু-রক্ত-ধ্বংসের নারকীয় রূপ দেখে। দাউদ ভয়ংকর, সেটা সবাই জানত। পূর্বসূরি হাজি মস্তানের মতো অনৈতিক কাজেও নির্দিষ্ট নীতি মেনে চলার কোনো বালাই ছিল না তার। হাজি কখনও নারী পাচারের মতো ঘৃণ্য ব্যবসায় হাত দেয়নি। দাউদ সেসবও করেছে চুটিয়ে। হাওয়ালা থেকে মাদক পাচার, কিছুতেই তার অরুচি ছিল না। কিন্তু এমন জঙ্গি হামলাও সে করে ফেলবে এটা সকলের কাছেই অকল্পনীয় ছিল।
যদিও দাউদ প্রথমদিকে বলার চেষ্টা করেছিল, ওসব কাজ সে করেনি। টাইগার মেমনরা করেছে। কিন্তু সেই যে এসবের নেপথ্যে আসল কলকাঠি নেড়েছিল, তা নিয়ে সন্দেহ নেই। ২০০৩ সালে ভারত ও মার্কিন সরকার দাউদকে ‘আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদী’র তকমা দিয়েছে। তার নামের পাশে জুড়েছে ‘মোস্ট ওয়ান্টেড’ শিরোপাও। শোনা যায় দাউদের ব্যবসা সারা বিশ্বে ছড়ানো। তার মোট সম্পত্তি ২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের থেকেও বেশি। সেই অর্থেই সে দখলে রেখেছে বহু কিছু।
দেখতে দেখতে কেটে গিয়েছে প্রায় তিন দশক। মুম্বাইয়ে আর নেই আন্ডারওয়ার্ল্ডের দাপাদাপি। পরিস্থিতি অনেকটাই বদলে গিয়েছে। অলিতে গলিতে ছায়াবাজির মতো হানাহানি, কাটাকাটির সেই সময় বহু দূরে ফেলে এসেছে আজকের বাণিজ্যনগরী। কিন্তু এত কিছুর পরেও দাউদ রয়ে গেছে বহাল তবিয়তেই। কী এমন কারণ রয়েছে যে তাকে দেশে ফেরানো যাচ্ছে না? গুঞ্জন রয়েছে, করাচিসহ পাকিস্তানের কোথায় কোথায় দাউদের বাড়ি, সেসব জানা সত্ত্বেও এগোনো যায়নি। কিন্তু কেন?
এর পেছনে অন্যতম কারণ পাকিস্তানের অসহযোগিতা। দেশটি বরাবরই জোর গলায় বলেছে, দাউদ তাদের দেশে নেই। অথচ বারবারই প্রমাণ মিলেছে দাউদের সেখানে থাকার। আসলে পাকিস্তান যে তাকে আশ্রয় দিয়েছে, সেই ‘ঋণ’ ভালোভাবেই চুকিয়েছে দাউদ। আক্ষরিক অর্থেই। জানা যায়, সেন্ট্রাল ব্যাংকের কাছে পাকিস্তানের বিপুল ঋণের একটা বড় অংশ সে শোধ করেছে। লস্কর-ই-তইবার মতো জঙ্গি দলকে দিয়েছে অস্ত্র কেনার টাকা। এখানেই শেষ নয়। নাইজেরিয়ার বোকো হারাম জঙ্গি গোষ্ঠীকেও বিস্তর অর্থ জুগিয়েছে দাউদ।
আরও একটা কারণের কথা শোনা যায়। মুম্বাই বিস্ফোরণের আগে বহু দুঁদে রাজনীতিবিদ, যাদের অনেকেই পরবর্তী সময়ে সাংসদও হয়েছেন, তারা দাউদের থেকে প্রত্যক্ষ মদত নিয়েছিলেন। তালিকায় নাকি অন্যান্য ক্ষেত্রের প্রভাবশালীও রয়েছেন। বলা হয়, একবার ভারতে ফিরলে দাউদ নাকি সকলের মুখোশ খুলে দেবে। আর সেই ভয়েই তারা কেউ চান না দাউদকে দেশে ফেরাতে। তাই নিজেদের প্রভাব খাটিয়ে চলেন নিরন্তর। এমন এক গুঞ্জন কিন্তু রয়েছে।
0 মন্তব্যসমূহ