আফ্রিকার লেক ভিক্টোরিয়ার কুখ্যাত দ্বীপ রেম্বা আইল্যান্ড, যৌনকর্মী, ড্রাগ ও মদের স্বর্গরাজ্য



আফ্রিকা মহাদেশের বৃহত্তম এবং পৃথিবীর তৃতীয় বৃহত্তম হ্রদ হলো লেক ভিক্টোরিয়া ( Lake victoria)। কেনিয়া, তানজানিয়া এবং উগান্ডার মধ্যবর্তী একটি সুউচ্চ মালভূমির উপর এই লেকের অবস্থান। আফ্রিকার বিখ্যাত শ্বেত-নীল নদের  উৎপত্তি লেক ভিক্টোরিয়া থেকেই। হ্রদটি দৈর্ঘে ৩৫৯ কিলোমিটার, প্রস্থে ৩৩৭ কিলোমিটার, আয়তনে ৫৯,৯৪৭ বর্গ কিলোমিটার। লেক ভিক্টোরিয়ার নীল জলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় ৩,০০০ টি দ্বীপ।

এগুলির মধ্যে অনেক দ্বীপেই আছে জনবসতি। হ্রদের জলে মাছ ধরেই বাঁচছেন হাজার হাজার যাযাবর মৎস্যজীবী। যাঁদের নিজস্ব বাড়ি-ঘর নেই। আজ এই দ্বীপ, তো কাল ওই দ্বীপে ভবঘুরের মতো ঘুরে বেড়ান তাঁরা। এই লেকের জলে বিখ্যাত নাইল-পার্চ মাছ। ইউরোপে এই মাছের বিশাল চাহিদা রয়েছে। ১৯৫৪ সাল থেকে এই লেকে নাইচ-পার্চ মাছের চাষ হয়ে আসছে। বর্তমানে, নাইল-পার্চ মাছ আর নাইল তেলাপিয়া মাছের রাজত্ব লেক ভিক্টোরিয়ায়।



লেক ভিক্টোরিয়ার ঘন নীল জলে ভেসে থাকা ৩,০০০ দ্বীপের মধ্যে লুকিয়ে আছে কেনিয়ার আওতায় থাকা এক কুখ্যাত ও বিতর্কিত দ্বীপ রেম্বা আইল্যান্ড। এর অধিকার নিয়ে কেনিয়া আর উগান্ডার মধ্যে এখনও চলছে চুলোচুলি। এই দুই দেশের সীমানা থেকে লেক ভিক্টোরিয়ার নীল নিস্তরঙ্গ জলরাশি ঠেলে ৩ কিলোমিটার গেলে, তবে খোঁজ মিলবে এই কুৎসিত দর্শন দ্বীপের। যৌনকর্মী, আফ্রিকার কুখ্যাত অপরাধী, ড্রাগ পাচারকারীদের স্বর্গরাজ্য এই রেম্বা আইল্যান্ড।


দ্বীপের নাম রেম্বা আইল্যান্ড

২০০৯ সালে এই  দ্বীপের জনসংখ্যা ছিল মাত্র ১৩১ জন। মাত্র ২০০০ বর্গ মিটারের এই দ্বীপের বর্তমান জনসংখ্যা ২০ হাজারের আশপাশে। পূর্ণবয়স্ক পুরুষদের মধ্যে ৬০ শতাংশ মানুষের জীবনযাত্রা পুরোপুরি লেক ভিক্টোরিয়ার জলে মাছ ধরার উপর নির্ভরশীল। বাকি ৪০ শতাংশ এই দ্বীপে অন্য ব্যবসা করেন।

ক্ষুদ্র দ্বীপটি যেন খুদে আফ্রিকা। আফ্রিকার সব দেশের মানুষদের এখানে পাবেন। তবে জনসংখ্যার ২০% হচ্ছে কেনিয়ার আবাসুবাস, লুয়ো এবং সোমালিয়ার অধিবাসী। এছাড়া দক্ষিণ সুদান, কঙ্গো, তানজানিয়া, উগান্ডা ও অন্যান্য দেশের লোকেরাও থাকেন এই দ্বীপে।


কী আছে সেখানে

লেক ভিক্টোরিয়ার নীল জলে ঘেরা এই দ্বীপে সৌন্দর্যের নাম গন্ধ নেই।  এইটুকু দ্বীপে গায়ে গায়ে ঘেঁষাঘেঁষি করে দাঁড়িয়ে আছে করোগেটেড টিনের চালাঘর। জীবনযাত্রায় সামান্যতম পরিকল্পনা নেই এখান জনজাতির। স্বেচ্ছায় অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে দিনের পরদিন  কাটাচ্ছেন দ্বীপবাসীরা। এই ২০০০ বর্গমিটার এলাকার মধ্যে আছে, মাছের আড়ত, একটি গির্জা, একটি মসজিদ, জুয়ার অসংখ্য কাউন্টার, মদ ও ড্রাগের পাব, সেলুন, ওষুধের দোকান, খাবার হোটেল ও হাজার তিনেক যৌনকর্মী।
অফুরন্ত নারীসঙ্গ, মদ আর ড্রাগ

অস্টিন অমোণ্ডি একজন মৎসজীবী ও রেম্বার অস্থায়ী আবাসিক। তাঁর কথায়, ” বাইরের লোকেরা জানেন এই রেম্বা দ্বীপের মূল ব্যবসা মাছ, সে এই লেকের সব দ্বীপেই হয়। এখানে বিভিন্ন জিনিস বেচাকেনা হলেও মূল পণ্য হচ্ছে নারীদেহ, ড্রাগ, জুয়া আর স্থানীয় মদ ছাঙ্গা। লোকে যেমন এখানে আমির হয়, তেমনি ফকিরও হয়। এখানে দেহব্যবসা বেআইনি নয়“। ছোট্ট দ্বীপটিতে পা ফেলার জায়গা নেই, গিজগিজ করছে মানুষ।

চার দিক থেকে এসে ভিড়ছে মাছ ভর্তি জেলে নৌকো। সারাদিনের হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে ধরা মাছ রেম্বাতে বেচে, সেই পয়সা দিয়েই পতিতা সঙ্গ করে, ড্রাগ ও মদে উড়িয়ে পরদিন আবার নৌকা নিয়ে জলে নামছেন হাজার হাজার মৎস্যজীবী। আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ থেকে রেম্বাতে এসে ওঠেন যৌনকর্মীরা। কেউ সন্তান নিয়ে আসেন, কারও এখানে এসে সন্তান হয়।


অপেক্ষা করছে নির্মম ভবিষ্যৎ
বয়স হয়ে গেলে দ্বীপ ছাড়তে হয়, নয়তো যৌনরোগ ধরা পড়ে গেলে বদনাম হবে। দিনে একজন যৌনকর্মী ভারতীয় মুদ্রায় ২৫০০ থেকে ৫০০০ টাকা আয় করেন। দ্বীপে ব্যাঙ্ক নেই, তাই  টাকা রাখতে বাধ্য হন নিজের পোশাকে। সেই টাকা কখনও খরিদ্দার কেড়ে নেন, তো কখনও দ্বীপের দাদারা। তাই কয়েক সপ্তাহ পরপরই টাকাকড়ি ট্যাঁকে গুঁজে উধাও হয়ে যান বেশ কিছু যৌনকর্মী, সঙ্গে করে বয়ে নিয়ে যান যৌন রোগ।

খালি জায়গায় আমদানি হয় নতুন যৌনকর্মীর। রেম্বা দ্বীপের সারি সারি টিনের চালাঘরে বিভিন্ন বয়সের যৌনকর্মীদের ভিড়। জায়গা নেই তাই একই ঘরে দশ বারো জন যৌনকর্মী একই সঙ্গে খরিদ্দার সামলান। ঘরের বাইরে অপেক্ষায় থাকেন খরিদ্দারের দল। যৌনকর্মীদের শিশুরা রাস্তায় খেলে বেড়ায়, অপরিচিত লোকদের হাতে যৌন নিগ্রহের শিকার হয়, আর টিনের ঘরে যৌন শোষিত হয় তাদের মায়েরা।

প্রতিদিন ৫০ লক্ষ টাকার মাছ ব্যবসা হয় রেম্বা দ্বীপে

জেলে নৌকোর মালিকদের বেশিরভাগই এই দ্বীপে বাস করেন না। বেশিরভাগ বোট মালিক রেম্বা দ্বীপে তাঁদের এজেন্ট রেখে দিয়েছেন। এজেন্টদের  কাছ থেকে যন্ত্রচালিত নৌকা ভাড়া নিয়ে জলে নামেন মৎস্যজীবীরা।  অনেক সময় এজেন্টরা জেলে ভাড়া করে জলে নৌকা নামান। বেশিরভাগ জেলেই ১২-৩৫ বছরের স্কুলছুট তরুণ।

লাভের ৭০-৮০ শতাংশ মুনাফা পান বোট মালিক , বাকি ২০-৩০ শতাংশ পান জেলেরা। একজন বোট মালিক যত খুশি নৌকা রাখতে পারেন। একজন উগান্ডার মহিলার মালিকানাতেই প্রায় ৩৫টি বোট আছে। এই বোট মালিকরাই অন্যান্য ব্যবসা চালান। দোকান, সেলুন, হোটেল থেকে বার, এমনকি পতিতাপল্লীও।


ঠাঁই নাই,তবু ফুর্তি চাই

টিনের ছাউনি দেওয়া বাড়িগুলি, প্রতি চব্বিশ ঘণ্টায় দু’বার ভাড়া দেওয়া হয়। ঘরগুলি দিনে একজন ও রাত্রে আর একজন ভাড়া নেন। যাঁরা রাতে মাছ ধরেন, দিনের  জন্য ঘর ভাড়া নেন। কেউ দিনে মাছ ধরলে ,ঘর ভাড়া নেন রাতটুকুর জন্যই। ভাড়া ৬৯০ থেকে ৩০০০ টাকা ( ভারতীয় মুদ্রায়)। এই বাড়িগুলিকে বলে “উসিসেমে‘।  কিছু ‘উসিসেমে’ বাড়ি যৌনকর্মীরা ভাড়া নিয়ে রাখেন। তাঁদের ব্যবসা চালানোর জন্য। প্রতিদিন ভোরে রেম্বা দ্বীপ থেকে ২০০ জন লোক চলে যান এবং প্রতিদিন এই দ্বীপে ৪৯০ জন নতুন লোক ঢোকেন।

পয়সা ফেলেও, এই ছোট্ট দ্বীপের টিনের ঘরগুলিতে সবার থাকার জায়গা হয় না। রোজ অসংখ্য মানুষ রেম্বা দ্বীপের ঠাণ্ডা আবর্জনায় ঠাসা সৈকতে (বানডা) রাতে শুয়ে থাকেন। কারণ এখানে আসা বেশিরভাগ মৎস্যজীবীই যাযাবর ধরনের। বিশাল লেক ভিক্টোরিয়ার জলে ও দ্বীপে দ্বীপে ঘুরে ঘুরে মাছ ধরেন। তাঁরা কোথায় কখন থাকবেন নির্ভর করে, কোথায় মাছ পাওয়া যাচ্ছে তার উপর। এঁদের বেশিরভাগেরই নিজস্ব বাড়ি নেই। থাকলেও বছরে একবার হয়ত বাড়ি যাওয়ার সুযোগ মেলে মাছ মাফিয়াদের হাতে পায়ে ধরে।


পয়সা নিয়ে সুরক্ষা দেয় কেনিয়ার মাসাইরা

রেম্বাতে কোনও নিয়মিত পুলিশ বাহিনী নেই। এই দ্বীপে মাত্র ৯ জন পুলিশ আছেন , এঁদের পক্ষে ২০,০০০ মানুষকে সামলানো অসম্ভব। দুর্বল আইন ও দুর্বল প্রশাসন থাকায়  আজ রেম্বা হয়ে উঠেছে যৌনকর্মী ও ক্রিমিনালদের স্বর্গরাজ্য।  অপরাধ করে আইনের হাত এড়িয়ে রেম্বাতে লুকিয়ে থাকা ও রেম্বা থেকে পার্শ্ববর্তী যে কোনও দেশে পালিয়ে যাওয়া অত্যন্ত সহজ।

এর ফলে এখানকার সাধারণ মৎসজীবীরা নিত্যদিন হেনস্থা ও বাটপাড়ির শিকার হন। একদল বিচ্ছিন্ন ও অপরাধপ্রবণ মাসাই হলো এই অদ্ভুত দ্বীপের সেনবাহিনী। দ্বীপের প্রভাবশালী ব্যবসায়ীরা কেনিয়ার মাসাইদের পয়সা দিয়ে পোষেন। পরিবর্তে মাসাইরা সুরক্ষা দেয়। তারা নৌকা ভাসিয়ে পাক খায় দ্বীপের চারদিকে।


নারকীয় পরিবেশ

রেম্বাতে স্বাস্থ্য ও পরিস্কার পরিচ্ছন্নতার কথা কেউ ভাবেন না। দ্বীপের চার দিকে থিক থিক করছে আবর্জনা। মলমূত্র,ব্যবহৃত স্যানিটারি প্যাড থেকে কন্ডোম, ইঞ্জেকশনের সিরিঞ্জ ও ছুঁচ। এই পরিবেশে বাস করছেন ২০,০০০ মানুষ। দ্বীপের চারদিকে লেকের জলে ভাসছে আবর্জনা। কাক চিলেরা খুঁটে খুঁটে খাচ্ছে। সেই নোংরা জলেই চলছে, স্নান করা থেকে রান্নাবান্না। চতুর্দিকে শুঁটকি মাছ, ফেলে দেওয়া পচা মাছের গন্ধের সঙ্গে মিশে আছে মদের গন্ধ।

কুড়ি হাজার মানুষের জন্য আছে মাত্র চারটি পাবলিক টয়লেট। এর মধ্যে দুটি টয়লেট বরাদ্য, টিনের চাল দেওয়া  ২০ ফুট বাই ২০ ফুটের একটি  প্রাইমারি স্কুলের জন্য। সে দুটি তালা চাবি দেওয়া থাকে। টয়লেট বলতে মাটির ভেতরে করা গর্ত, চার দিকে আড়াল, এইটুকুই। বেশিরভাগ মানুষ লেকের তীরেই বসে যান, লজ্জার মাথা খেয়ে। দূষণ ও আবর্জনায় দ্বীপের পরিবেশ এখন পুরোপুরি নরক।
রেম্বা আইল্যান্ডে মদ বেচেন ওটিয়েনো ওরিয়ারো। তিনি বললেন “দ্বীপে ওষুধের দোকান আছে।  কিন্তু যিনি দোকানদার তিনিই ডাক্তার। চিকিৎসকরা হাতুড়ে। ভুল ওষুধে শিশুর মৃত্যু নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনা। বেশির ভাগ দোকান চলে নেশার ট্যাবলেট, অন্যান্য ড্রাগ ও কন্ডোম বিক্রি করে।”  শিশুদের মধ্যে অপুষ্টি ও মানুষজনের মধ্যে যৌনরোগ দ্রুত ছড়িয়ে যাচ্ছে। এর মধ্যে সবার আগে আছে এডস।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ