বাংলাদেশে প্রাকৃতিক গ্যাস ও পেট্রোলিয়াম



বাংলাদেশ এশিয়ার সপ্তম বৃহৎ গ্যাস উৎপাদনকারী দেশ। দেশীয় জ্বালানী চাহিদার ৫৬ শতাংশ পূরণ করে গ্যাস।[১] যাহোক, বৃহৎ ও ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাহিদা মেটাতে দেশটিকে তীব্র জ্বালানী সংকটের মুখে পড়তে হয়। বাংলাদেশ অপরিশোধিত তেল ও খনিজ দ্রব্যাদির অন্যতম আমদানিকারক দেশ। এ দেশের জ্বালানী খাত রাষ্ট্র মালিকানাধীন কোম্পানি যেমন বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন ও পেট্রোবাংলা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। এদেশের হাইড্রোকার্বন শিল্পে কাজ করা আন্তর্জাতিক কোম্পানিগুলোর মধ্যে রয়েছে শেভরন, কনোকোফিলিপস, স্ট্যাটওয়েল, গ্যাসপ্রম এবং ওএনজিসি। যেখানে প্রাকৃতিক গ্যাস উৎপাদনের ৫০ শতাংশ আসে শেভরনের গ্যাস কূপগুলো থেকে। ভূতত্ত্ববীদদের বিশ্বাস, দেশের সমুদ্রসীমার এক্সক্লুসিভ ইকোনোমিক জোনে এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের অন্যতম বৃহৎ তেল ও গ্যাসের মজুদ রয়েছে। সংরক্ষন জ্ঞান ও কারিগরি দক্ষতার অভাব বাংলাদেশকে প্রথম সারির বৈশ্বিক হাইড্রোকার্বন প্রস্তুতকারক দেশ হবার সম্ভাবনাকে বাধাগ্রস্ত করছে।

ইতিহাস

ইংরেজ শাসন আমলে খনিজ তেল ও গ্যাসের সন্ধানের কারণে পূর্ব বাংলা ও আসাম (সিলেট বিভাগ অন্তর্ভুক্ত) প্রদেশ ছিল বিশ্বের সর্বপ্রথম পেট্রোলিয়াম উৎপাদনকারীর মধ্যে একটি। ইন্দো-বাংলা পেট্রোলিয়াম কোম্পানি পূর্ব বাংলায় ১৯০৮ থেকে ১৯১৪ সালের ভেতর সর্বপ্রথম খনিজ তেলের কূপ খনন করে চট্টগ্রাম বিভাগে।পূর্ব বাংলায় ১৯৫৫ সালে বার্মা খনিজ তেল কোম্পানি চট্টগ্রাম বিভাগে প্রথম তেলের সন্ধান পায়। শেল অয়েল কোম্পানি এবং পাকিস্তান পেট্রোলিয়াম আশির দশকে সাতটি গ্যাসক্ষেত্রের সন্ধান পায়।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের পর, শেখ মুজিবুর রহমান নেতৃত্বে বাংলাদেশের প্রথম সরকারের বিদ্যুৎ ও খনিজসম্পদ মন্ত্রী ড. কামাল হোসেন বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম আইন পাশ করেন ১৯৭৪ সালে। তৎকালীন সরকার অনেক আন্তর্জাতিক তেল কোম্পানিকে বাংলাদেশে অনুসন্ধানে স্বাগত জানায়। সরকার পেট্রোবাংলাকে জাতীয় খনিজসম্পদ সংস্থা হিসাবে চালু করে। পেট্রোবাংলা আশির দশকে অনুসন্ধান কাজ তরান্বিত করে ও নয়টি নতুন গ্যাসক্ষেত্রের খোঁজ পায়। এছাড়াও ১৯৮৬ সালে পেট্রোবাংলা প্রথম বাণিজ্যিক তেল শোধনাগার স্থাপন করে।

নব্বইয়ের দশকে জালালাবাদ, মৌলভীবাজার বিবিয়ানা ও বাঙ্গুরা-লালমাই হতে বিভিন্ন বহুজাতিক গ্যাস ও তেল কোম্পানি তেল উত্তোলন শুরু করে। যাদের মধ্য শেল ও ইউনোকাল অন্যতম। বৃহত্তর তেল কোম্পানি শেভরন ২০০৫ সালে যাত্রা শুরু করে।

সামুদ্রিক অনুসন্ধান
১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ সরকার মহীসোপান এর সাতটি অংশ ছয়টি আন্তর্জাতিক তেল কোম্পানিকে অনুসন্ধানে দেয়। কিন্তু, ১৯৭৮ সাল নাগাদ কোম্পানিগুলি যান্ত্রিক অসুবিধা ও রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতাকে কারণ দেখিয়ে চলে যায়। তাদের প্রধান লক্ষ্য ছিল তেল, কিন্তু অনুসন্ধানে তেলের নয় বরং গ্যাস পাওয়া যায়। কিন্তু তখন থেকে বিশ্বে পেট্রোলিয়াম পরিস্থিতি পরিবর্তন আসে। সামুদ্রিক অনুসন্ধানের প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও আন্তর্জাতিক তেল কোম্পানিগুলির গ্যাস অনুসন্ধানের আগ্রহ অনেক বৃদ্ধি পায়। ১৯৯৮ সালে বাংলাদেশ সরকার অগভীর সমুদ্রে চারটি অংশ নতুন কয়েকটি আন্তর্জাতিক তেল কম্পানিকে অনুসন্ধানে দেয়। শেল, কেরিন এনার্জি ও সান্তোস এই তিনটি কোম্পানি সামুদ্রিক গ্যাসক্ষেত্র সাঙ্গু পরিচালনা করছে।

বাংলাদেশে বড় আকারের গ্যাস ক্ষেত্র সর্বশেষ আবিষ্কৃত হয়েছিল হবিগঞ্জ জেলার বিবিয়ানা গ্যাস ক্ষেত্র।

জ্বালানী বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বড় ধরণের গ্যাস ক্ষেত্র আবিষ্কার হবার জায়গা হচ্ছে গভীর সমুদ্র।

ভারত এবং মিয়ানমারের সাথে বাংলাদেশের সমুদ্র সীমা নিষ্পত্তি হলেও সমুদ্রে গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কারের জন্য অনুসন্ধান চালানো হয়নি।

যদিও সমুদ্র সীমা নিষ্পত্তির পরে মিয়ানমার বেশ দ্রুততার সাথেই গ্যাস ক্ষেত্র আবিষ্কার করেছে।

অধ্যাপক বদরুল ইমাম বলেন, "আমরা মনে করি বাংলাদেশের সাগর বক্ষে যথেষ্ট পরিমাণ গ্যাস আছে।যদি সেগুলো অনুসন্ধান এবং উত্তোলন করা হতো, তাহলে এখন যে গ্যাস ক্রাইসিস আছে সেটা হতোই না।"

তিনি বলেন, "এটা একটা হতাশাজনক চিত্র। গত ১০-১৫ বছরে উল্লেখযোগ্য কোন গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার হয় নাই।"

একই কথা বলছেন অধ্যাপক ম. তামিম।

তিনি বলেন,গ্যাস সংকট থেকে মুক্তির উপায় দুটি। বিদেশ থেকে এলএনজি গ্যাস আমদানি করা এবং আরেকটি উপায় হচ্ছে গ্যাস খুঁজে বের করা।

"আমাদের নিজস্ব গ্যাস শেষ হয়ে গেছে, একথা কেউ বলতে পারবে না। নতুন মজুদ আমরা আর পাবো না এটা বলা যাবে না।"

কিন্তু গ্যাস ক্ষেত্র পাওয়ার জন্য যে ধরণের উদ্যোগ দরকার সেটি একেবারেই অনুপস্থিত বলে উল্লেখ করেন অধ্যাপক তামিম।

বাংলাদেশে এখন প্রতিবছর যে পরিমাণ গ্যাস ব্যবহৃত হচ্ছে, সেটির চাহিদা ১০ শতাংশ হারে বাড়ছে।

সমুদ্রে গ্যাস অনুসন্ধান হচ্ছে না কেন?
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বাংলাদেশের গভীর সমুদ্রে গ্যাস প্রাপ্তির যথেষ্ট সম্ভাবনা আছে।

বঙ্গোপসাগরে এখন বাংলাদেশের ২৬টি ব্লক রয়েছে। এর মধ্যে ১৩টি অগভীর সমুদ্রে এবং ১৩টি গভীর সমুদ্রে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, গভীর সমুদ্রে গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য অবশ্যই বিদেশি কোম্পানিগুলোর উপর নির্ভর করতে হবে।

বিদেশি কোম্পানিগুলো যাতে বাংলাদেশের সমুদ্র সীমায় গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য আগ্রহী হয়, সেজন্য বাংলাদেশের তরফ একটি তথ্যভাণ্ডার গড়ে তুলতে হবে।

অধ্যাপক বদরুল ইমাম বলেন, "তারা তো একটা খালি মাঠে চোখ বন্ধ করে আসতে চায় না। বিদেশি কোম্পানিগুলো ডাটাবেস-এর উপর ভিত্তি করে সিদ্ধান্ত নেয় তারা কোন দিকে যাবে।"

সমুদ্রে গ্যাস অনুসন্ধান করতে হলে একটি সার্ভে বা জরিপ করার কথা উল্লেখ করছেন অধ্যাপক তামিম। তিনি বলেন, জরিপের মাধ্যমে যদি কোন তথ্য না পাওয়া যায়, তাহলে বিদেশি কোম্পানিগুলোর আগ্রহ তৈরি হবে না।

এ ধরনের জরিপের মাধ্যমে জানা যাবে সমুদ্রে গ্যাস প্রাপ্তির সম্ভাবনা কতটা আছে।

প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানী উপদেষ্টা বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, গ্যাস সংকট মোকাবেলায় বাংলাদেশ এরই মধ্যে এলএনজি আমদানি শুরু করেছে।

তিনি বলেন, বাংলাদেশে এখন যে পরিমাণ গ্যাস উত্তোলন করা হয়, আগামী তিন-চার বছর পরে সেটি আরো কমে যাবে।

জ্বালানী উপদেষ্টা বলেন, এরই মধ্যে কয়েকটি গ্যাস ক্ষেত্র পাওয়া গেছে। মিয়ানমারে কাছে সমুদ্রে গ্যাস প্রাপ্তির সম্ভাবনা আছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ